Mdigitech

Aboddho Prem Part 6 | Bangla Love Story

সকাল আটটা বেজে দশ মিনিট । নিঃশব্দ এক বৃষ্টির সকাল। আকাশজুড়ে কালো মেঘের চাদর যেন সূর্যের আলোকে গিলে ফেলেছে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, শহরের চেনা কোলাহল আজ হারিয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষের ছায়াও নেই—শুধু থেমে থেমে বৃষ্টির শব্দ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো শীতলতার ছোঁয়া।
একদিকে আবহাওয়ার এই উদ্ভট আচরণ, অন্যদিকে রুপের মায়ের শরীর ভালো নেই। অথচ আজ হেড অফিসে কিছু জরুরি কাগজ জমা দিতে হবে। আয়েশা বেগম অসুস্থ শরীরেই তৈরি হচ্ছেন দেখে রুপ বলে উঠল,
— “মা, তোমার যেতে হবে না। আমি গিয়ে কাগজ গুলো দিয়ে আসি। তুমি রাবেয়া আন্টিকে একটা ফোন করে দাও, উনি যেন কাগজগুলো জমা দিয়ে দেন। আমি উনার হাতে দিয়ে আসব।”
— “তা নাহয় দিবে, কিন্তু এই বৃষ্টি বাদলের দিনে তুই যাবি কিভাবে?”
— “তোমার কী মনে হয় আমি কোনোদিন বড় হব না? আমি তো ভার্সিটিতে পড়ি মা, এইটুকু রাস্তা যেতে পারব না?”
— “হয়তো পারবি, কিন্তু আমার ভয় করে। যদি আমার চাঁদের দিকে কারোর কুনজর পড়ে! জানিস তো গরিবের মেয়ে হয়ে সুন্দরী হওয়া বড় অভিশাপ।”
— “মা, তুমি না সবসময় এই এক কথা বলো। আমি অতটা সুন্দরী নই যে লোকে তাকিয়ে থাকবে! দুঃচিন্তা করো না।”
— “আমি কেন ভয় পাই, তুই জানিস। আমি চাই না তোর জীবনটা আমার মতো হোক। যাই হোক,তুই এসব বুঝবি না। যেতে চাইছিস যা, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবি।”
— “ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি এত চিন্তা করো না।”
— “কেন যে চিন্তা করি… তুই যদি বুঝতি?”
— “আহ মা, সবসময় এসব ভাবতে হয়? আমরা তো ভালোই আছি, তাই না? বাবা ছাড়া মানুষ কি বড় হতে পারে না?”
রুপ কথা শেষ না করেই বেরিয়ে পড়ল। মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে মায়ের ক্লান্ত মুখ আর নিজের দায়িত্ববোধ। সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত অস্বস্তি।
বাইরে তখন থমথমে আবহাওয়া। আকাশে সূর্যের কোনো রং নেই, কেবল মেঘের কুণ্ডলী পাকানো কালচে স্তর।
রুপ হেড অফিসে পৌঁছে ঠিক সময়ে কাগজ জমা দিয়ে দিল। কিন্তু কাজ শেষ করে বাইরে বেরোতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রুপ ভেবেছিল বৃষ্টি থেমে যাবে, তাই সঙ্গে ছাতা আনেনি। কিন্তু বৃষ্টি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ঝুম বর্ষণে। রুপ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে রিকশার খোঁজ করছে। শরীরের প্রতিটি জায়গা বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাচ্ছে। কাপড়গুলো গায়ে লেপ্টে আছে। আজ আর ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না, কোনমতে শুধু বাড়ি পৌঁছতে পারলেই হয়।
ঠিক তখনই—একটা গাড়ি এসে থামল তার কিছুটা সামনে। রুপ চোখ কুঁচকে তাকাল। গাড়ি থেকে নেমে এল একটা পরিচিত অবয়ব। মাথায় কোট চাপিয়ে একজন ছেলেকে এগিয়ে আসতে লাগল। রুপ কিছু বুঝে উঠার আগেই ছেলেটি তার মাথায় কোটটা তুলে দিল।
এবার তার মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল—জান।
তবে আজকের জান যেন একেবারে অন্যরকম। সাদা ফুল স্লিভ শার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে ঘড়ি, চুল গোছানো পরিপাটি—একটা শীতল কিন্তু মার্জিত সৌন্দর্যে মোড়া। রুপ কিছু বলার আগেই জান রাগী গলায় বলে উঠল—
— “তুমি এখানে কী করছো? ইডিয়েটের মতো বৃষ্টিতে ভিজার মানে কী?”
রুপ অপমানিত বোধ করল, ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু কিছু বলার আগেই জান তার হাত টেনে নিয়ে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিল।
রুপ প্রতিবাদ করতে গিয়ে থমকে গেল—
— “তোমার মাথায় যদি সামান্য বুদ্ধিও থাকত, তাহলে বুঝতে পারতে এই আবহাওয়ায় এমন জনশুন্য রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে থাকা উচিত না।”
রুপ এবার মুখ গোমড়া করে বলল,
— “আপনি এতক্ষণ ধরে কিসব বলে যাচ্ছেন?”
— “আর কী বলব? এভাবে নিজেকে ভিজিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা কি খুব স্মার্টনেস?”
— “ইচ্ছা করে কেউ ভিজে নাকি?”
— “তোমার মতো বোকারাই ভিজে!”
— “ভিজলে ভিজব, আমার ব্যাপার! আপনাকে দেখতে বলেছে কে?”
রুপ দরজা খুলে নামতে যাচ্ছিল, কিন্তু জান হাতে ধরে আটকে দিল।
— “একদম বাড়াবাড়ি করবে না। এমন করে ভিজে যদি জ্বর আসে…
— “আসুক জ্বর! তাতে আপনার কী? আর আপনি হঠাৎ এখানে কেন?”
— “অফিসে একটা মিটিং ছিলো শেষ করে ফিরছিলাম আমার কথা বাদ দিয়ে বলো, তুমি এখানে কেন?
—” একটা কাজে এসেছিলাম
—“এখন কোথায় যাবে? বাসায় নাকি ভার্সিটিতে?”
— “বাসায় যাব…”
রুপ বাসায় যাবার কথা বললেও জানের গাড়ি কোন দিকে ছুটে চলেছে রুপ তা বুঝে উঠতে পারল না। গাড়ি এসে থামল এক শপিং মলের সামনে। রুপ অবাক, গাড়ি থেকে নামতেই জান তার হাত ধরে তাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল মলের ভেতর। আশপাশ ফাঁকা, বৃষ্টির কারণে ক্রেতা নেই বললেই চলে। এক অদ্ভুত নীরবতা চারদিকে।
জান সোজা তাকিয়ে বলল,
— “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? যাও, একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করে এসো।”
রুপ চোখ বড় করে বলল,
— “ড্রেস চেঞ্জ করব মানে?”
— “ভিজে গেছো পুরো। এমন থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। তাই যা বলছি করো।”
রুপ এবার জোরে বলে উঠল,
— “আপনি কিন্তু সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি কেন আপনার কথা শুনবো?আমি কোনো চেঞ্জ করব না। এখনই বাসায় যাব!”
জান শান্ত গলায় বলল,
— “নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো তো… তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”
— “ম…মানে?”
— “মানে জামা ভিজে শরীরের প্রতিটা ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে। শরীরটা কাপড়ের নিচে নেই, যেন কাপড়টাই শরীর হয়ে গিয়েছে।”
রুপ তাড়াতাড়ি ওড়না টেনে গায়ে জড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল,
— “আপনি এসব কী বলছেন!”
— “মিথ্যে কিছু বলিনি। যা চোখে পড়েছে, তাই বলেছি। আমার জায়গায় অন্য কোন ছেলে থাকলে হয়তো আরো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারতো। এখন চেঞ্জ করবে কি করবে না, সেটা তোমার ইচ্ছা।”
রুপ চারপাশটা একবার দেখল । নিঃসঙ্গ, শূন্য মল। এমন পরিবেশে জানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, ভেজা শরীর, ঠান্ডা বাতাস, অজানা এক ভয়—সব মিলিয়ে তার ভিতরটা কেঁপে উঠল। আর কিছু না বলে সে একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জিং রুমের দিকে হাঁটল।
চেঞ্জিং রুমে ঢুকে কাপা হাতে কাপড় ধরল রুপ। জানের সেই কঠিন চোখের ভাষা তার ভিতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ভয় পেয়েছে সে—হ্যাঁ, এই ছেলেটা আগের সব ছেলেদের থেকেও ভয়ংকর। কিন্তু তারপরও… তার পাশে দাঁড়ালে কেন যেন এক ধরনের নিরাপত্তা কাজ করে। একটা অলিখিত স্বস্তি। যেন এই ভয়টাও জরুরি, কোনো না কোনোভাবে তার জীবনের সঙ্গে জড়িত।
🍁
রুপ ড্রেস চেঞ্জ করে চুপচাপ বেরিয়ে আসলো মাথার ভেতরে তখনো ঝড় চলছে—নিজেকে অপরিচিত এক জায়গায় আবিষ্কার করার ভয়, জিসানের আচরণের দ্বিধাজনক আন্তরিকতা, আর মায়ের চিন্তা।রুপ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই জিসান তার জামার বিল মিটিয়ে রুপকে আরেক দফায় গাড়িতে নিয়ে গেল।
রুপ কিছু বলার আগেই গাড়ি আবার ছুটে চলল অজানার দিকে। বাইরে তখন বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। রাস্তায় গাড়ির চাকা পানিতে ছলছল শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে, গতি যেন সময়কে অতিক্রম করছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এল রুপের। অবশেষে সে ধীরস্বরে বলল,
— “জিসান ভাই, আমার কথাটা একটু শুনবেন?”
জিসান চোখ সরাল না রাস্তা থেকে, ঠোঁটের কোণে এক ধরণের বিরক্তির ছায়া থাকলেও সুরটা ছিল ঠান্ডা,
— “বলো, শুনছি।”
রুপ দম নিয়ে বলল,
— “আমার এখন সত্যিই বাসায় যেতে হবে। আমাকে প্লিজ বাসায় নামিয়ে দিন।”
জিসান এবার এক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তোমার মা নিশ্চয়ই একজন বিচক্ষণ মহিলা। এই জামা পরে বাসায় গেলে, কিছু বলবেন না?”
রুপ হঠাৎ থমকে গেল।
— “তাই তো… আমি তো সেটা ভাবিইনি… তাহলে জামা বদলে যাই?”
জিসান গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “নিশ্চয়ই যাবে। আগে ভিজা জামা কাপড় শুকাক।”
— “কিন্তু সেতো অনেক সময় লাগবে।”
— “হ্যাঁ, সময় তো লাগবেই।”
— “এতক্ষণ বাসায় না ফিরলে মা চিন্তা করবে।”
— “তুমি নিজেও জানো এখন তুমি ফিরতে পারবে না,আমি ফিরতে দিব না।তবে যখন বাসায় ফিরবে তোমাকে বলতে হবে, কাজ শেষে ভার্সিটিতে গিয়েছিলে। সেটা বিশ্বাসযোগ্য লাগবে। তাহলে বকা খাবে না”
—“মিথ্যা বলব?
–“সত্যি বললে ভালো হবে? যদি তাই মনে করো তাহলে সত্যিটাই বলে দিও। কিন্তু এখন তুমি কোথাও যাচ্ছ না এটা ফাইনাল।

রুপ আর কিছু বলল না। জানের চোখে ছিল না কোনো কোমলতা, মুখের অভিব্যক্তি কঠিন, কিন্তু তার প্রতিটি কাজ যেন অদ্ভুতভাবে যত্নে মোড়া। সেই অদ্ভুত যত্নেই যেন রুপ নিঃশব্দে হার মানল। জানে তর্ক করে লাভ নেই—এই ছেলেটির ভিতরে যেন নিজের মতোই এক জেদ পুষে রাখা মানুষ বাস করে। তাই চুপ করে বসল গাড়ির সিটে।
গাড়ি ছুটে চলল শহরের প্রান্ত ছুঁয়ে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। বাইরের দিকের দৃশ্যগুলো জানালার কাচে ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির রেখায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ির গতি ধীরে থেমে গেল।
রুপ দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই চোখ বড় হয়ে গেল। চারপাশে সবুজের ঢেউ। মেঘলা আকাশের নিচে বালুতে মোড়া এক বিস্তৃত চর। দূরে একটা ছোট নদী, যার উপর দিয়ে হাওয়া বয়ে নিয়ে আসছে জলীয় কণার স্পর্শ। ঘাসের মাঝে চার কোণায় বাঁশ পুঁতে, তার উপর খড় দিয়ে বানানো একটি ছোট খোলা ঘর—আড্ডার আদর্শ স্থান। যেন এক টুকরো নির্জন স্বর্গ।
কোথাও মানুষজন নেই। এক পাশে রাস্তার ধারে একটা ছোট টং দোকান—তাও বৃষ্টির জন্য বন্ধ, শাটার নামানো। চারদিকে শুধু প্রকৃতি আর নিঃস্তব্ধতা।
রুপ তাকিয়ে রইল হাঁ করে। নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ শব্দ, বৃষ্টির ফোঁটা আর বাতাসের গন্ধে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। ঠিক তখনই জিসানের কণ্ঠ ভেসে এল—
— “জায়গাটা কেমন?”
রুপ কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “এটা তো স্বপ্নের মতো! আপনি এই জায়গাটা কিভাবে পেলেন?”
জান হেসে বলল,
— “আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এটা। আমরা বন্ধুরা প্রায়ই আসি এখানে। খোলা আকাশ, নদী, ঝড়ের দিন, গানের সুর আর নির্জনতা—সবই আছে এখানে। আজকে ভাবলাম, তোমাকেও এই জায়গার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”

চলবে..!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top