Mdigitech

Aboddho Prem Part 2 | Bangla Thriller Story

গল্পটা শুরু হয়েছিলো রুপ যেদিন ভার্সিটিতে প্রথম পা রাখে সেদিন। ভোরবেলা, হালকা কুয়াশায় ঢাকা ক্যাম্পাস যেন এক টুকরো নিঃশব্দ কবিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছিল জান। ঠিক তখনই ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা—জানের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট হঠাৎ কেড়ে নিল এক অচেনা মেয়ে। মুহূর্তে স্তব্ধতা নেমে এল চারপাশে। বন্ধুরা সবাই বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে, যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছে মনে হচ্ছে সিনেমার দৃশ্য সামনে থেকে দেখছে।

জান হতবাক। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন দুঃসাহস দেখানোর মতো সাহসী কেউ আছে বলে তার জানা নেই। হঠাৎ কেড়ে নেওয়া সিগারেট শুধু তার অহংবোধেই নয়, আত্মমর্যাদার ওপরও যেন আঘাত হানল। চোখে আগুন নিয়ে তাকাল সে মেয়েটির দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই বিস্ময়ের ছোঁয়ায় তার সমস্ত রাগ গলে গেল। সে যেন সম্মোহিত হয়ে গেল।মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়েই জানের মন রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠল—কী অপার্থিব মায়া ছড়িয়ে আছে তার মুখাবয়বে! এক নিখাদ সরলতা, যেন কচি পল্লবের ওপর শিশির বিন্দু। পরনে সাদামাটা সুতির সালোয়ার-কামিজ, দুধে আলতা রঙের কোমল ত্বক, ঘন পাপড়ির আড়ালে লুকানো দু’টি চোখে হালকা —কাজলের ছায়া, খোলা চুলে মেয়েটির শরীরজুড়ে ছড়িয়ে আছে এক স্বচ্ছ পবিত্রতা, যেন সদ্য ফুটে ওঠা কোনো বনফুল।
আর সেই ফুলের গায়ে যেন লেগে আছে অনাবিল সুবাস, যা মন ভালো করে দেয়।

এতদিন শোনা কথা ছিল, ফুল আশে পাশে থাকলে মন শান্ত হয়। কিন্তু আজ, জান সেটা অনুভব করল নিজের ভেতরে।
মেয়েটি হয়তো না বুঝেই এমন কাজ করে ফেলেছে। এখন বুঝতে পেরে অস্থির হয়ে উঠেছে। একেবারে ভীতু হরিণীর মতো পিটপিট করে তাকিয়ে আছে, জানের চোখে চোখ রেখে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে বারবার, যেন ভয় চেপে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করছে সে।
জানের এখন রাগ হওয়ার কথা—অসম্ভব রকমের রাগ,কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার রাগ হচ্ছে না। মন শান্ত হয়ে আছে। সে নিজেও জানে না, কেন রাগ আসছে না! মেয়েটির মুখে অপার্থিব সরলতা আর খোলা চুলের মিষ্টি ঘ্রাণে যেন তার অন্তর আলোকিত হয়ে উঠছে। জান হেসে ফেলল—মুগ্ধ হাসি হেসে নরম স্বরে বলল,
— “ফার্স্ট ইয়ারের বিল্ডিংটা ওদিকে। ক্লাসে যাও।”

মেয়েটি এক মুহূর্তও দেরি করল না। চোখ নামিয়ে জানের দেখানো দিকে ছুটে গেল। পিছনে রইল হতবাক জানের বন্ধুরা। এমন ঘটনায় যেখানে বিস্ফোরণ ঘটার কথা, সেখানে জানের মুখে শান্ত হাসি! ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হল অনেকের, বিশেষ করে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু জিমের।
জিম এগিয়ে এসে বলল—
— “ব্যাপারটা কী ভাই? আমাকে তো কিছু বলিসনি…!”
জান একটু অবাক হয়ে বলল—
— “কি বলব…?”
— “আমাকে তো অন্তত বলা উচিত ছিল! আমি তো সব কিছু তোকে বলি, আর তুই এমন একটা ঘটনার কিছুই আমাকে বললি না?”
— “ কী বলব, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
— “প্রেম করছিস আবার বলছিস,কী বলবি জানিস না! মেয়েটার ব্যাপারে আমাকে অন্তত বলা উচিত ছিল!”
জিমের কথায় জান অবাক হয়ে বলল,
— “প্রেম,কিসের প্রেম? মেয়েটাকে তো আমি নিজেই এই প্রথম দেখলাম। তোকে আবার কী বলব?”
— “অপরিচিতা একটা মেয়ে এসে তোর হাত থেকে সিগারেট ছিনিয়ে নিল, আর তুই তার সঙ্গে মিষ্টি হেসে কথা বললি! এটাও এখন বিশ্বাস করতে হবে?”

— “আমি সত্যিই মেয়েটাকে চিনি না। হয়তো অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য করেছিল, কিন্তু পরে ভয় পেয়েছে। তাই ছেড়ে দিয়েছি।

—“অসম্ভব,এটা কি করে হতে পারে? তুই কাউকে এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র না।

—” ছেড়ে দিব কে বলল? আবির—এক কাজ কর। খোঁজ নে, কে এই মেয়ে! কোথায় থাকে, কী করে,ওর সমস্ত খবর আমার চাই।”

জানের বলতে দেরি হলেও, আবিরের যেতে সময় লাগল না। আবির খোঁজ নিচ্ছে, জান মুখে কিছু না বললেও মন যেন অধীর অপেক্ষায়। কিছুক্ষন পর আবির ফিরে আসলো,
— “দোস্ত, খোঁজ পেয়েছি,” হঠাৎ বলে উঠল আবির।
জান চমকে তাকাল।
— “নাম রুপ। নতুন ভর্তি হয়েছে ফার্স্ট ইয়ারে—ইংরেজি বিভাগে।  ফর্মাল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোথাও তার পদচারণা নেই। ছবি পর্যন্ত পাওয়া যায় না।” জানের মুখে এক অজানা প্রশান্তি। রুপ—নামটা কেমন যেন তার বুকের ভেতর ধাক্কা দিল।

জান ছোট করে প্রশ্ন করল,
__” আর..?

— ” কাছেই ভাড়া থাকে, কয়েক মাস হয়েছে এখানে এসেছে। বাবা নেই,মায়ের সঙ্গে থাকে। মা ছোটখাটো একটা অফিসে চাকরি করে। ভাইবোন নেই।”
— “আর…?”

— “বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কখনো কারও সঙ্গে তর্ক করতে শোনা যায়নি। বাসা থেকে তেমন বের হয় না। চুপচাপ থাকে।”

— “আর?”

— “সবই তো বললাম আর কী!”

আবিরের কথায় জান কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
— “যেটা জানা সবচেয়ে জরুরি, সেটাই বলিসনি। আমি জানতে চেয়েছি, বিশেষ কেউ আছে, যাকে রাস্তা থেকে সরাতে হবে?”

— “এই ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। এলাকায় নতুন এসেছে, তাই প্রেম করে কিনা কেউ জানে না। তবে কোনো ছেলের সঙ্গে মিশতে দেখা যায়নি। যদিও কোনো মেয়ের সঙ্গেও না। মোট কথা—বন্ধুবান্ধব নেই।”

— “আলহামদুলিল্লাহ! যেমনটা চেয়েছিলাম, একদম তাই। যদিও থাকলেও অসুবিধা ছিল না তাকে সরিয়ে হলেও নিজের জায়গা করে নিতাম।

জানের কথায় জিম বেশ অবাক হলো। এগিয়ে এসে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
— “তুই এসব কী বলছিস, জান? তুই কি প্রেম করার কথা ভাবছিস নাকি?”

— “তো তোর কি মনে হয়? এর আগে কখনো কোনো মেয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছি?”

— “জান, মেয়েটা তোর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে আর তুই সেই ফাঁদে পা দিচ্ছিস? বুঝতে পারছিস না ওর ইচ্ছেটা কী?”

— “যদি তাই হয়, তাহলে বলব মেয়েটা সফল হয়েছে। আমার সকল মনোযোগ সে কেড়ে নিতে পেরেছে সে ।

আবির, যা জানতে বলেছিলাম, সেটা কর।”
জিম আবার চেঁচিয়ে বলল,
— “পাগলামিটা একটু বন্ধ করবি? মেয়েটা তোকে ফাঁসাতে চাইছে আর তুই যেচে গিয়ে ফাঁদে পা দিচ্ছিস!”
— “আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার ওপর পড়েছে। বলতেই পারিস—Love at first sight! আমার আর কিছু করার নেই। ওকে আমার চাই, যে করেই হোক।”
🍁
ক্লাস শেষ। ক্যাম্পাসে নেমেছে বিকেলের আলো—সোনালি রোদ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে জানের গাল ছুঁয়ে।
জান আজ সারাদিন অস্থির থেকেছে। বারবার তাকিয়েছে ক্লাস বিল্ডিংয়ের দিকটায়, যেখানে হারিয়ে গেছে সেই অচেনা মেয়ে। মনের ভেতরে অজানা টান, অদ্ভুত এক আকর্ষণ জমে উঠেছে। পরিচয় নেই, জানা শোনা কিছুই নেই—তবুও মেয়েটি অস্বিত্ব যেন মাথা থেকে যাচ্ছেই না।

গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জান। তার পাশেই পেঁচার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে জিম। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলল,

— “কত মেয়ে পিছনে ঘুরল, কোনোদিন ফিরেও তাকাস নি, আর সেই তুই কিনা আজ অচেনা অজানা একটা মেয়ের জন্য এতক্ষন ধরে মাছি তাড়াচ্ছিস?”

জিমের কথায় জান মুখ কালো করে জবাব দিল,
— “আমি কি তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি? তোর খারাপ লাগলে তুই চলে যা। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে কথা না বলে কোথাও যাব না।”

জিম বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর গলায় বলল,
— “ওই যে মহারানী আসছে। যা যা, খাল কেটে কুমিরটা নিয়ে আয়…”

জিমের কথা শুনে জান ফোল্ড করা শার্টের হাতা টেনে ঠিক করল, নিজের চুলে হাত বুলিয়ে পরিপাটি হয়ে নিল। রুপের দিকে এগিয়ে গিয়ে কথা বলার জন্য ঘুরে তাকাল, কিন্তু হঠাৎই বুঝতে পারল—সে এগোতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে, নাক-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।

জানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিম চেঁচাল,
— “সং-এর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মহারানী চলে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছিস না?”

বলে জিম মুখ তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। জান বলল,
— “আমার কেমন যেন নার্ভাস লাগছে, জিম। আজ থাক, যা বলার কাল বলব।”
জিম বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
— “সারাদিন এত লোকের সঙ্গে কথা বলিস আর সামান্য একটা মেয়ের সামনে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিস? লক্ষণ তো ভালো না জান, তুই কি সত্যিই প্রেমে পড়ে গেছিস?”
— “জানি না। তবে এর আগে এমন কিছু আমার সঙ্গে হয়নি।”
🍁
পরদিন সকাল থেকেই জান গেটে অপেক্ষা করছে। সাথে তার বন্ধুরাও। কিন্তু যার জন্য অপেক্ষা, সে নেই। অনেকক্ষণ পর, সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রুপ কলেজে ঢুকল। জান সবাইকে বিদায় করে নিজে এগিয়ে গেল।
জানকে এগিয়ে আসতে দেখে রুপ ভয় পেয়ে গেল। জান পথ আগলে দাঁড়াল।
রুপ পিটপিট করে তাকাল জানের দিকে জান বলল,
— “একটু কথা বলা যাবে?”

রুপ উত্তর দিতে পারল না। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে সে ভয় প্রকাশ করল। মনে হলো—এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। কিছু না বলে এক দৌড়ে চলে গেল। জান কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু এভাবে একটা মেয়ের পিছু নেওয়াটা খারাপ দেখায়। তাই সিদ্ধান্ত নিল, যা বলার ছুটির পর বলবে।

কিন্তু সকাল পেরিয়ে বিকেল, এমনকি দিন পেরিয়ে দিন চলে যাচ্ছে—রুপের আর কোনো খোঁজ নেই। জান প্রতিদিন অপেক্ষা করে, কিন্তু রুপ আসে না। রাগে জানের শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
সে জিমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জিম জিজ্ঞেস করল,
— “কিছু হয়েছে জান? চোখ-মুখ এমন লাগছে কেন? আবার মারামারি করেছিস?”
জান জবাব দিল,
— “না করিনি, তবে করব।”
— “মানে?”
— “তুই না বলেছিলি মেয়েটা আমাকে ফাঁসাতে চায়? তাহলে এখন কোথায় সে? যা গিয়ে বল—আমি ফাঁসতে চাই! এসে যেন আমাকে ফাঁসায়। যদি না আসে, তোকে মে*রে তক্তা বানিয়ে দেব!”
জিম হেসে ফেলল,
— “এই জন্যে স্যারের মেজাজ খারাপ? মেয়েরা সব পারে—আবার প্রমাণ হল। যাকগে, আবির, খোঁজ নে তো ম্যাডাম ভিক্টোরিয়া কোথায় আছেন? কলেজে আসে না কেন?”

বলতে বলতেই আবির চলে গেল। জিম জানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
— “এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই,শান্ত হ।”

— “দু’দিন ধরে দিন-রাত অপেক্ষা করছি, মেয়েটার খোঁজ নেই—অস্থির হব না?”

— ” শরীর খারাপও তো হতে পারে, তাই কলেজে আসেনি। তবে তুই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস, জান। যে নিজে থেকে সামনে আসতে চাইছে না, তাকে টেনে আনার কী দরকার?”

জান রেগে তেঁতে উঠল,
— “দরকার আছে। আমার ওকে চাই।”

— “জান, একটু বুঝে চল। তুই ওর সম্পর্কে কিছুই জানিস না। তোর শত্রুর অভাব নেই। এটা কোনো ষড়যন্ত্রও হতে পারে।”

— “ও যদি মানুষ না হয়ে নাগিনও হয়, তবুও আমার ওকে চাই।

___” আবেগ দিয়ে জীবন চলে না দোস্ত।

__” চিন্তা করিস না, যে যতই ষড়যন্ত্র করুক, জানের একটা চুলও ছিঁড়তে পারবে না। ও যদি ষড়যন্ত্র করেও থাকে আমি ওকে ভালোবেসে আমার করে নেব।”

এই সময় আবির ফিরে এল। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
— “কি রে? মেয়েটা কলেজে আসে না?”
তার কণ্ঠে সন্দেহ ও বিস্ময়ের সুর। আবির বলল,
— “ক্লাসে আসে। তার এক ব্যাচমেট বলেছে, ক্লাস শুরুর কিছুক্ষণ পর আসে। পিছনের দরজা দিয়ে ঢোকে আর ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই সেই পথেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়।”

—“বেশ এবার সময় এসেছে সামনে আসার।
.
চলবে..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top