অফিসের নিস্তব্ধ কেবিনে অরণ্য বসে আছে, হাতে ফোন, চোখে জ্বলন্ত ক্রোধ। তার চোয়াল শক্ত, ভ্রূ কুঁচকে আছে। হঠাৎ দরজা খুলে শুভ প্রবেশ করল।
__“ফুল আর চকলেটের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাবে।
অরণ্য মাথা নাড়ল, তারপর চট করে উঠে দাঁড়াল,
__“শুভ, আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি। তুই এখানকার কাজগুলো একটু সামলে নিস।
শুভ অবাক হয়ে তাকাল।
__“এখন বাড়ি যাবি? কিন্তু মিটিংটা? আজ তো গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা হওয়ার কথা ছিল!”
অরণ্য শুভকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
__“মিটিং পরে হবে। আমার এখন একটা জরুরি হিসাব মেটাতে হবে।
শুভ আর কিছু বলল না। তবে সে বুঝতে পারল কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। তার মনে অস্বস্তি হলেও তা প্রকাশ করার সুযোগ পেল না। অরণ্য নিজের কোটটা তুলে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
অরণ্যের গাড়ির চাকা যেন পিচ গিলতে গিলতে ছুটে চলেছে। চোখেমুখে আগুন জ্বলছে তার। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। দুই হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরা। ড্যাশবোর্ডে রাখা ফোনটা কাঁপতে কাঁপতে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু অরণ্যের বুকের ভেতর গর্জন যেন থামছে না।
__“আমার স্পষ্ট নিষেধ অমান্য করার সাহস সিমরানের হয় কীভাবে? ও কি ভেবেছে আমার কোন কথার মূল্য দিবে না?
অরণ্যের চোখে যেন আগুন লেগেছে, ভ্রু দুটো কুঁচকে আছে ভয়ংকর রকম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি থামল হাসপাতালের সামনে।
দ্বারে থাকা সিকিউরিটি চোখ তুলে তাকাতেই অরণ্যের উপস্থিতি দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
সে কোনো কথা বলল না, অরণ্য দ্রুত পা ফেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
অন্যদিকে, হাসপাতালে সিমরান তার বাবার হাত ধরে বসে আছে। তার বাবার ক্লান্ত হাসি তার মনে একটা ক্ষীণ আশা জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু তার মনের গভীরে অরণ্যের ভয় তাকে তাড়া করছে—অরণ্য ফিরে এলে কী হবে? সে জানে, তার এই ক্ষণিকের স্বাধীনতার মূল্য তাকে অনেক বড় করে দিতে হবে। তবু সে তার বাবার হাত শক্ত করে ধরে রইল।
__“বাবা, তুমি এখন কেমন বোধ করছো? শরীরটা কি একটু ভালো লাগছে?” সে কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
কামাল হোসেন মাথা নেড়ে বললেন,
__“ডাক্তার বলেছে, অপারেশন ভালোভাবে হয়েছে। আমি এখন অনেকটাই আরামে আছি, মা। কিন্তু এত টাকা তুই কোথায় পেলি? এই অপারেশনের খরচ তো কম ছিল না। কীভাবে জোগাড় করলি এত টাকা?” তার চোখে উৎকণ্ঠা ও কৌতূহল মিশে গেল।
সিমরানের বুক ধড়ফড় করে উঠল। সত্যিটা বলতে গিয়েও তার গলা আটকে গেল। অরণ্যের সঙ্গে তার চুক্তি, তার অপমান, তার বন্দি জীবন—এসব বাবাকে কীভাবে বলবে? সে জানে, এই সত্যি তার বাবার হৃদয় ভেঙে দেবে। সে গলা পরিষ্কার করে, মাথা নিচু করে বলল,
__“বাবা, আমি… আমি একটা চাকরি পেয়েছি। বেশ ভালো বেতনের। অফিস থেকে একটা লোন নিয়েছি, তাই অপারেশনের খরচ জোগাড় করতে পেরেছি। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না।”
মেয়ের কথায় কামাল হোসেনের মুখে হাসি ফুটল।
__“চাকরি? আমার মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে! কী চাকরি, মা? কোথায় ? তার কণ্ঠে গর্ব, কিন্তু দুর্বলতার ছোঁয়া।
সিমরানের বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা আঘাত হানল। সে মিথ্যে বলছে, কিন্তু তার আর কোনো উপায় নেই। সে নরম কণ্ঠে বলল,
__“একটা কোম্পানিতে, বাবা। তবে… একটু থামল, বলতে দ্বিধা করল, কিন্তু পরক্ষণে বলল, চাকরির জন্য আমাকে কিছুদিন বাইরে থাকতে হবে। আমি চাইলেও ঘনঘন আসতে পারব না।”
কামাল হোসেন কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন,
__“বাইরে মানে শহরের বাইরে? কতদিন থাকতে হবে তোকে? আর এত বেতন যেহেতু দিচ্ছে, নিশ্চয়ই ভালো পদে কাজ করছিস, তাই না?”
বাবার কথায় সিমরানের চোখে অশ্রু জমা হল। বাবার কত স্বপ্ন ছিল মেয়ে বড় হয়ে ভালো একটা চাকরি করবে। সিমরানও সবসময় সেই চেষ্টা করেছে, প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষায় তাক লাগানো রেজাল্ট করেছে। ইচ্ছা ছিল গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরিতে যোগ দেবে, কিন্তু সেই সুযোগ আর পেল কই। সিমরান নিজের অশ্রু লুকিয়ে বলল,
__“বাবা, তুমি চিন্তা করো না। তুমি শুধু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো, আমি আর কিছু চাই না। আমি ঠিক আছি, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।”
কামাল হোসেন হাসলেন।
__“আমার মেয়ে এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আর চিন্তা করব না। তুই শুধু নিজের খেয়াল রাখিস, মা। কাজের চাপে যেন শরীর ভেঙে না পড়ে।” তিনি সিমরানের হাত শক্ত করে ধরলেন।
সিমরানের চোখে অশ্রু জমা হল, কিন্তু সে তা লুকিয়ে হাসল। বাবার এই হাসি, তার এই শান্ত মুখ—এটাই তার জীবনের একমাত্র আশার আলো। সে মনে মনে বলল, “তোমার জন্য আমি সব সহ্য করব, বাবা। শুধু তুমি ঠিক হয়ে যাও।”
বাবার হাতে সিমরানের হাত, সে যেন একমুঠো শান্তি খুঁজে পেয়েছে আজ। এই কয়েকদিন একটানা কান্নার পর একটা নিঃশব্দ ভালোলাগা তার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মুখের সেই সামান্য হাসিই যেন তার শত অপমান আর কষ্টের মলম হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কেবিনের দরজার সামনে একজন নার্স এসে দাঁড়াল।
__“ম্যাডাম, দর্শনের সময় শেষ হয়ে গেছে। আপনাকে এখন যেতে হবে। দয়া করে তাড়াতাড়ি করুন।”
সিমরান একবার বাবার দিকে তাকাল। তারপর বলল,
__“বাবা, আমি এখন যাই? আমি আবার আসব, খুব তাড়াতাড়ি। তুমি নিজের খেয়াল রাখবে, ঠিক আছে?”
কামাল হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
__“সাবধানে থাকিস, মা। নিজের খেয়াল রাখিস। আমি ঠিক হয়ে যাব, তুই চিন্তা করিস না।”
__“হ্যাঁ, বাবা, আমি নিজের খেয়াক রাখব। তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠো,” সে ফিসফিস করে বলল।
তারপর ধীরে ধীরে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। হাসপাতালের করিডোরটা এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ভরা—চারদিকে ধবধবে সাদা দেয়াল, সিলিং থেকে ঝুলে থাকা আলো, আর মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে জরুরি ওয়ার্ডের যন্ত্রের শব্দ। সিমরান ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল।
চোখ লাল, মুখটা বিবর্ণ। হাতের তালুতে শক্ত করে ধরে আছে ছোট্ট একটা পানির বোতল।
বাবার সঙ্গে দেখা করে বুকটা কিছুটা হালকা হয়েছে, কিন্তু একটা ভয় এখনো তার শিরা-উপশিরায় বইছে—অরণ্য জানলে কী হবে?
আর তখনই… সামনে থেকে হঠাৎ করেই তার দৃষ্টি পড়ল অরণ্যের চোখে।
দুজনে থেমে গেল। সমস্ত করিডোর নিস্তব্ধ হয়ে গেল যেন। সাদা আলোতে অরণ্যের মুখটা কুয়াশা ভেদ করে আসা বজ্রপাতের মতো ভয়ঙ্কর লাগছে।
চোখদুটি রক্তবর্ণ, ঠোঁটের কোণে প্রচণ্ড রাগ।
সিমরান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার পা আর এগোতে পারছে না। সারা শরীর জমে গিয়েছে। সে এতটাই ভয় পেল যে হাত থেকে পানির বোতলটা পড়ে গেল নিচে টক করে, শব্দটা যেন একটা শকওয়েভের মতো বেজে উঠল সিমরানের মনে।
অরণ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
তার প্রতিটি পা যেন ধ্বংসের বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসছে।
__“এখানে কী করছিস, সিমরান? আমি তোকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছিলাম কোথাও না যাওয়ার জন্য। তবু তুই এখানে?”
অরণ্যের কণ্ঠ এতটাই কাঁপন ধরানো যে, সিমরান মনে করল গলার স্বরের তীব্রতায় সে মাটিতে গলে যাবে।
সিমরান কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“আমার… আমার বাবা… অপারেশন হয়েছে…আমি শুধু একটু দেখতে এসেছিলাম।”
সিমরান ভয়ে ঠিক মত কথা বলতে পারছে না। তার কথা শেষ হতেই অরণ্য সাথে সাথে বলল,
__“আমি তোকে স্পষ্ট নিষেধ করেছিলাম, সিমরান। আমার কথা অমান্য করার এত সাহস কোথায় পেলি তুই? তুই কি ভেবেছিস তুই আমার সব কথা অমান্য করবি আর আমি চুপচাপ মেনে নিব?”
অরণ্য তার দিকে ঝুঁকে এল।
__“তুই জানিস না আমার নিয়ম ভাঙার পরিণতি কী হতে পারে?”
সিমরানের চোখে অশ্রু যাওয়া হতে শুরু করল । গলার স্বর হারিয়ে যাচ্ছে। সে মাথা নিচু করে বলল,
__“আমি ফিরে যাচ্ছিলাম… আমি আর কিছু করিনি… বিশ্বাস করুন… আমি শুধু বাবাকে একটু দেখতে এসেছিলাম…”
অরণ্য কোনো উত্তর দিল না। তার শক্ত হাত দিয়ে সিমরানের কব্জি মুঠোয় চেপে ধরল, আঙুলগুলো এমনভাবে সিমরানের ত্বকে গেঁথে গেল যেন তা ত্বকের ভেতরে ক্ষত তৈরি করছে। সে সিমরানকে টানতে টানতে কঠোর কণ্ঠে বলল,
__“বাড়ি চল। তোকে যথেষ্ট ‘দয়া’ দেখানো হয়েছে। এবার সময় এসেছে নিয়ম মানার শিক্ষা দেওয়ার।”
সিমরান কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“ভাইয়া, প্লিজ ছেড়ে দিন। আমার হাতে খুব ব্যথা লাগছে… দয়া করে হাতটা ছাড়ুন… আমি কিছু করিনি…
__“ব্যথা? তুই এখনো ব্যথা কী তা বুঝিসনি, সিমরান। ব্যথা কাকে বলে, আমি তোকে এবার ঠিকঠাক বোঝাব।”
সে সিমরানকে টানতে টানতে হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল। সিমরান আর কাঁদতে পারছে না—তার ভয়ের মাত্রা এতটাই চূড়ায় উঠেছে যে, কণ্ঠ থেকেও আওয়াজ বের হচ্ছে না। অরণ্য গাড়ির দরজা খুলে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল তাকে।
সিমরানের কাঁধ গিয়ে লাগল দরজার ধাতব প্যানেলে। সে কুঁকড়ে গেল, হালকা একটা গোঙানি বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
অরণ্য সামনে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল।
পুরো রাস্তাজুড়ে কোনো শব্দ নেই—শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন আর ভেতরে জমে থাকা নিঃশব্দ হাহাকার।