জানের চোখে ম একই সংকল্প—যেটা একবার গেঁথে বসলে আর কেউ তাকে দমাতে পারে না।
পরের দিন সে স্থিরভাবে বাইরে তাকিয়ে ছিল। তার চোখের দৃষ্টিটা যেন কোথাও থেমে নেই, কোথাও ছুটে চলেছে। মনে হচ্ছিল, জান এখন শুধু একটা কাজের অপেক্ষায়।
আবির ফিরে এসে জানিয়ে দিল,
— “রুপ আজও কলেজে এসেছে। আগের মতোই, পিছনের দরজা দিয়ে।”
জান মাথা নেড়ে বলল,
— “ঠিক আছে, সময় এসেছে সামনে আসার।”
জিম তখনও জানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে শুধু আতঙ্ক আর সংশয়।
— “জান, আমি তোর বন্ধু। তোর মনের অন্ধকার দিকটা আমি জানি। কিন্তু এবার তুই সীমা ছাড়াচ্ছিস। ওকে ভয় ধরিয়ে লাভ কী? ভালোবাসা কি জোর করে পাওয়া যায়?”
জান ধীর গলায় বলল,
— “তুই জানিস না, জিম। এটা ভালোবাসা না, এটা দাবি। আমার চোখ যখন কোন জিনিস বেছে নেয়, তখন সেটা আর পেছনে ফেরে না।”
জিম হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। জানের মন যেন এক অচেনা জায়গায় চলে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন।
সেদিন বিকেলে কলেজের প্রায় সবাই চলে গিয়েছিল। আবির আগে থেকেই রুপের উপর নজর রাখেছিল—জান আর আবির কলেজের পিছনের করিডোরে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ নরম পায়ের শব্দ—দেয়ালে সরে আসা এক ঝলক ছায়া।
জান ইশারা করল। আবির পেছন থেকে একটু দূরে সরে গেল।
রুপ আজও আগের মতোই পিছনের গেইট দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাবে ভেবেছিলো, চুপচাপ, নিঃশব্দে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তি, আর ভয়ের একটা অদৃশ্য ছায়া লেপ্টে আছে। যেন প্রতিটি পা ফেলতে ফেলতে সে নিজেই নিজেকে বোঝায়—এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পথ, এভাবেই বাঁচা যায়।
রুপ একা একা হাঁটছিলো ঠিক তখনই জান তার সামনে এসে দাঁড়াল।রুপ চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল জানের চোখে। তারপর পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।
— “আপনি এখানে?
জান হাত বাড়িয়ে তার পথ আটকাল। গলায় অদ্ভুত কোমলতা এনে বলল,
— “তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি শুধু জানতে চাই—তুমি এভাবে আমাকে কেন এড়িয়ে যাচ্ছো?”
রুপের ঠোঁট কাঁপছে। মুখে একরাশ ভয়।
— “প্লিজ… আমাকে যেতে দিন।”
— “তুমি জানো না আমি কে?
রুপ তাকিয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড, তারপর চোখ নামিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। জান আবার তার পথ আটকাল—
— “আমার কথা শেষ হয় নি।”
রুপ থমকে দাঁড়াল। ঠোঁট কামড়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আমাকে যেতে দিন… প্লিজ…”
বলার সময়েই রুপের চোখ ছলছল করে উঠল। কান্নাভেজা সে মুখ জানকে মুহূর্তেই আবেগপ্রবণ করে তোলল। সে আর বাধা দিতে পারল না।
রুপ আবারও ছুটে পালিয়ে গেল… অজানার দিকে।
জান মুখে কিছু না বললেও তার মনের ভেতর আগুন জ্বলছে। মেয়েটা তাকে অবহেলা করছে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। জান হাঁটছে জিম এসে তার পাশে হাঁটতে শুরু করল আর বলল,
— “মেয়েটা তোর ওপর রাগান্বিত। তুই জোর দিচ্ছিস বেশি। মেয়েটা ভয় পেয়ে যাচ্ছে জান।”
জান দাঁড়িয়ে পড়ল।
— “ভয় পায়?কিন্তু কেন, আমি কী এমন করেছি? আমি তো শুধু চেয়েছি, একটু কথা বলতে!”
জিম হেসে বলল,
— “সবসময় কথা বলার আগে ভাবতে হয়, সামনে যে আছে তার মন কতটা নরম। তুই কথা বলছিস আগুন নিয়ে, আর সে তো জলরঙে আঁকা মানুষ!”
জান ঠোঁট ভ্রু কুচকে বলল,
— “যদি জল হয়, তবে আমার আগুনেই সে ফুটে উঠবে একদিন।”
জানের চোখে এক নতুন উত্তেজনা ফুটে উঠল। সে আবির কে ডেজে বলল,
— “আবির, আমার জন্য কয়েকটা কাজ করে দে তো…”
বলেই সে আবিরের কানে কানে কিছু বলল।
আবির মাথা নেড়ে হেসে বলল,
— “ঠিক আছে ভাই, তুমি যেমনটা বলবে, তেমনটাই হবে।”
কিন্তু এবার জিম বাধা দিল। হাত বাড়িয়ে আবিরকে থামিয়ে জানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “জান, মেয়েটা তোকে ভয় পেয়ে গেছে। সেদিন যা করেছিলো, হয়তো তোকে চিনতে পারেনি। পরে বুঝেছে তুই কে। প্লিজ, ওর কোনো ক্ষতি করিস না।”
জান হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে ছিল উন্মাদনা, ছিল দম্ভ।
— “কখনো দেখেছিস আমার শিকার হাতছাড়া হয়েছে? একবার নজরে পড়লে, এই চোখ আর সরবে না। আবির, যা বলেছি, সব কর।”
জিম ধীরে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
— “এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। আমি জানতাম, কিছুক্ষণ খেলার পরেই তুই বিরক্ত হয়ে যাবি। তারপর পুতুলটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবি। এই কারণেই তোকে থামাতে চেয়েছিলাম। মেয়েটার কোনো দোষ নেই, একবার ভেবে দেখ… প্লিজ।”
জান একবার জিমের দিকে তাকাল। ঠোঁটে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সে কিছু বলল না। কিন্তু সেই হাসিই বলে দিল—এই খেলা এখানেই থামবে না।
জিম এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়ল।
এই ভালোবাসার গল্পে যদি যুদ্ধের রঙ চেপে বসে, তবে পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে?
ক্যান্টিনের এক কোণে মাথা নিচু করে বসে আছে রুপ। তার চোখেমুখে ভয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আশপাশের শব্দগুলো যেন তার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। আজ সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি—পেট মোচড়াচ্ছে, মাথা ঘুরছে, তবুও বুকের ভেতর সেই ভয়টা যেন সবকিছুকে গ্রাস করে রেখেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে না পেরে ক্যান্টিনে এসেছে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর থেকে বারবার মাথা ঘুরিয়ে খেয়াল করছে আশপাশে—কোথাও জান আছে কি না।
পাশে বসে থাকা বান্ধবী শ্রেয়া হেসে বলল,
— “তুই অযথাই ভয় পাচ্ছিস, রুপ। তুই জিসান ভাইয়ের সাথে এমন কিছু করিসনি, যে ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে।”
রুপ মুখ নিচু করে কাঁপা গলায় বলল,
— “কিন্তু সবাই বলছে, উনি খুব ডেঞ্জারাস। আমি তো কারও সঙ্গে ঝামেলা করিনা শ্রেয়া। তুই জানিস, আমরা কতটা কষ্টে এসেছি এখানে। মা কিছু জানলে ভেঙে পড়বে। যদি শুনে কোনো ছেলের সঙ্গে সমস্যা হয়েছে, কিছুতেই মেনে নেবে না।”
শ্রেয়া তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
— “তুই চিন্তা করিস না। জিসান ভাই ক্যাম্পাসের হিরো ঠিকই, কিন্তু উনি এমন ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। আমি নিশ্চিত, উনি সব ভুলে গিয়েছেন।”
রুপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “সেই জন্যই তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কিছুদিন লুকিয়ে থাকি…তাহলে হয়তো ভুলে যাবেন।”
কথা বলতে বলতে দুজনেই খাওয়া শেষ করল। রুপ বিল দিতে কাউন্টারে গেল। টাকা বাড়িয়ে দিতেই ক্যান্টিনের লোকটি হেসে বলল,
__” তোমাদের টাকা দিতে হবে না।
রুপ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
— “মানে? টাকা দিতে হবে না মানে?”
— “তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে জিসান নিষেধ করেছেন মা। সব বিল জিসান দিবে ক্যান্টিনের—সবকিছু তোমার জন্য ফ্রি। যা খুশি নিতে পারো।”
— “আপনি এসব কী বলছেন ?”
— “সত্যি বলছি।”
— “উনি বললেই আপনি টাকা নেবেন না?”
লোকটা উত্তর দেওয়ার আগেই শ্রেয়া রুপকে টেনে বের করে আনল।
রুপ হেঁচকা টানে বাধা দিয়ে বলল,
— “কি করছিস শ্রেয়া? এমন করে টেনে আনলি কেন?”
শ্রেয়া বলল,
— “তুই ভুলভাল প্রশ্ন করছিস তাই। জিসান ভাই মাস্তান টাইপের লোক, উনি নিষেধ করেছেন তাই টাকা নিবে না। চাচার সঙ্গে ঝামেলা না করে, ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলাটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নে রুপ।”
রুপ একটু ভেবে বলল,
— “ঠিকই বলেছিস। এভাবে পালিয়ে কতদিন চলব? আর উনি যদি এখনো ব্যাপারটা ভুলে না গিয়ে থাকেন, তাহলে সামনে গিয়ে একবার ক্ষমা চেয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ।”
গেটের পাশে তখন জান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ দূরে রুপকে এগিয়ে আসতে দেখে জিম চাপা স্বরে বলল,
— “মেয়েটা আসছে, জান… প্লিজ, মেয়ে হিসেবে অন্তত একটু ছাড় দে …”
জান চোখের ইশারায় জিমকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— “তুই যেমন ভাবছিস, আমি তেমন কিছু করিনি জিম।”
— “তুই কিছু করিস নি এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস না প্লিজ। কিছু না করলে, যে মেয়ে তোর ভয়ে ঠিকমত ক্লাস করতে পারছে না, সে নিজ থেকে এখানে আসছে ?”
জান ঠোঁটে একরাশ হাসি টেনে বলল,
—“করেছি তবে তুই যেমন ভাবছিস, আমি তেমন কিছু করিনি। বিশ্বাস কর খারাপ কিছু করিনি।
— “ কথা না পেঁচিয়ে কি করেছিস সেটা বল ”
— “ভদ্র মেয়েদের আত্মসম্মান খুব জোরালো হয় তারা কারও টাকায় চলতে চায় না। আমি ওর জন্য ক্যান্টিনে সবকিছু ফ্রি করে দিয়েছিলাম। জানতাম, এটা করলে ও মেনে নিতে পারবে না। আত্মসম্মান ওকে ঠেলে আনবে আমার কাছে। দেখ, এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেল। ও লোভী নয় সেটাও বুঝা গেল, আর নিজেই এসে আমাকে ধরা দিল।”
জিম আর জানের কথার মাঝেই রুপ সামনে এসে দাঁড়াল। চোখেমুখে ভয়, ভেতরটা কাঁপছে যেন। জান হাতের ইশারায় চারপাশে থাকা সবাইকে সরিয়ে দিল। মুহূর্তেই নিঃশব্দ হয়ে উঠল পুরো জায়গাটা।
রুপ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, মাথা নিচু। জান চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
— “কিছু বলবে…?” জানের কণ্ঠে এক অদ্ভুত প্রশ্রয়।
রুপ কথা খুঁজে পেল না, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
— “আমি… মানে আমি… ভাইয়া, আমি সত্যিই দুঃখিত সেদিনের জন্য। বুঝতে পারিনি আপনি এত রেগে যাবেন। আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।”
জান ভ্রু কুঁচকালো,
— “আমি কি বলেছি তুমি ভুল করেছো? তাহলে ক্ষমা চাইছো কেন?”
— “আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি আমার সেদিন এমন করা ঠিক হয়নি। একজন অপরিচিত ব্যাক্তির হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নেয়া কোনভাবেই উচিত হয়নি। আপনি রাগ করেছেন আমি জানি, আমি আমার ভুল শুধরে নিতে চাই।
—“কিভাবে শুধরাবে..?
—” আচ্ছা ওদিনের সিগারেটের বদলে আমি যদি আপনাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিই তাহলে কি আপনি আমায় ক্ষমা করে দিবেন…?”
জান চোখ সরু করে তাকাল,
— “সিগারেট কেন ফেলে দিয়েছো সেই ব্যাপারে আমি কি কোন অভিযোগ করেছি?”
রুপ গলা নরম করে বলল,
— “না তা করেন নি… তবে যদি আপনার মন খারাপ হয়, তাহলে…”
জান হালকা হাসল,
— “আচ্ছা বেশ তাহলে, কিনে দাও।”
রুপ কৌতূহল মেশানো স্বরে বলল,
— “আজকেই দিতে হবে…?”
জান চোখ তুলে চেয়ে থাকল। তীব্র সেই দৃষ্টি দেখে রুপ তড়িঘড়ি করে বলল,
— “আসলে আমার কাছে টাকা নেই। আপনি যদি একটু সময় দেন তাহলে বাসা থেকে নিয়ে আসতে পারব। আমার বাসা কাছেই, বেশি সময় লাগবে না…”
জান একটু মাথা হেলিয়ে বলল,
— “তোমার বাসার সামনে দোকান নেই?”
— “আছে।”
— “তাহলে সেখান থেকেই কিনে দিও। আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।”
রুপ থমকে তাকাল, চোখে অবিশ্বাস। কিছু না বলেই হেঁটে চলল সে। জান তার পাশে—চুপচাপ হাঁটছে, চোখে খেলা করছে মৃদু রহস্য।
হাঁটতে হাঁটতে জান বলল,
— “তুমি প্রতিদিন হেঁটে যাওয়া আসা করো?”
রুপ একটু থেমে বলল,
— “না… মানে, আপনার সঙ্গে রিকশায় গেলে যদি কেউ কিছু খারাপ ভাবে…”
জান হেসে ফেলল।
— “তুমি আমাকে চিনো?”
— “নাহ… তবে নাম শুনেছি, জিসান চৌধুরী সবাই জান বলে ডাকে…”
— “জান নামটা কেমন?”
— “ভালো।”
— “তোমার নাম কি?
—” রুপ।
—“পুরো নাম কি?
—“এটাই আমার নাম আগে পিছে আর কিছু নেই।
জান চোখ সরু করে তাকাল তারপর হালকা ভঙ্গিতে বলল,
— “একটা প্রশ্ন করব, যদি কিছু মনে না করো তো?”
রূপ মাথা নাড়ল,
— “কিছু মনে করব না। বলুন।”
— “তুমি সেদিন এমন করলে কেন?”
প্রশ্নটা শুনেই রূপ থমকে গেল। মুখে কুয়াশার মতো ভয় নেমে এল, যেন পুরনো দুঃশ্চিন্তাগুলো আবার ভেতরটা আঁকড়ে ধরছে।
জান দ্রুত বলল,
— “আরে, ভয় পেও না। আমি তোমাকে দোষারোপ করতে আসিনি। শুধু জানতে ইচ্ছে হলো—তাই জিজ্ঞেস করেছি।”
রূপ ধীরে ধীরে বলল,
— “আসলে আমি সিগারেট খাওয়া একদম সহ্য করতে পারি না। সেদিন নিজেকে থামাতে পারিনি । পরে খুব অনুশোচনা হচ্ছিল… তবে আমি এমন কিছু করে বসব নিজেও ভাবিনি কখনো।”
জান এবার একটু গম্ভীর হলো,
— “অনুশোচনার চেয়ে তোমার উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তুমি কি জানো, তুমি সেদিন কতটা অস্বাভাবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ করেছিলে?”
রূপ বোকা বোকা মুখে তাকিয়ে রইল।
জান ধীরে বলল,
— “আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না, শুধু বুঝাতে চাইছি। তুমি মেয়ে তাও একা ছিলে, ছেলেদের গ্রুপে ঢুকে এমন অদ্ভুত একটা কাজ করা কোনভাবেই ঠিক হয় নি। সেদিন আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত? কিংবা যদি কোনো নেশাগ্রস্ত গ্রুপে গিয়ে এমনটা করতে তোমার কী হতো, ভেবে দেখেছো? তোমার পছন্দ নয় বলে সমাজ তোমার ইচ্ছামতো চলবে—এমনটা হয় না, রূপ।”
রূপ মাথা নিচু করে নিল, কণ্ঠটা যেন গলায় আটকে গেল।
— “আমি আপনাকে কীভাবে বোঝাই… অন্য কাউকে সিগারেট খেতে দেখে কখনো এমনটা হয়নি আমার।আমি শুধু আপনার সিগারেট খাওয়াটা মেনে নিতে পারিনি। সেদিন আমি শুধু আপনার হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিইনি, আপনার চোখের অশান্তিটাও কেড়ে নিয়েছিলাম…”
এক মুহূর্ত নীরবতা। হঠাৎ জানের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল রূপ,
— “চুপ করে আছো কেন? বললাম তো, ভয় পেতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গে খারাপ কিছু করব না।
আমি শুধু বুঝাতে চাইছি—আর কখনো এমন কিছু করবে না, ঠিক আছে?”
রূপ মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “ঠিক আছে করব না।”
চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে পৌঁছাল গলির মোড়ে। রূপ থেমে বলল,
— “আপনি এখানেই দাঁড়ান। সামনেই আমার বাসা। কেউ আপনাকে আমার সঙ্গে দেখলে ভুল বুঝতে পারে।আমি যাব আর আসব, একটুও সময় নষ্ট করব না।”
জান হেসে মাথা নাড়ল। রূপ তাড়াতাড়ি দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। পুরনো ধাঁচের দোতালা বাড়ির বাইরের দিকে সিঁড়ি। রুপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে লাগল। জান তাকিয়ে রইল—চোখে একরাশ আগ্রহ সাথে চিন্তার নিঃশব্দ ঢেউ।
কিছুক্ষণ পর রূপ ফিরে এল। মেয়েটা রীতিমতো হাঁফাচ্ছে, কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে আছে একটা ৫০০ টাকার নোট। এসেই বলল,
— “ভাইয়া, দোকানে গিয়ে বলব…? আসলে আমি কখনো সিগারেট কিনিনি… জানি না কী বলতে হয়, সিগারেটের তো আলাদা আলাদা ব্র্যান্ড হয় তাই না?”
জান ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “তুমি একজনের সঙ্গে রিকশায় উঠলে লোকে খারাপ ভাববে, আর সেই ছেলের জন্য সিগারেট কিনলে কেউ কিছু ভাববে না?”
রূপ বিস্ময় মেশানো চোখে তাকিয়ে রইল। বোকার মতো স্থির মুখে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
জান হেসে ফেলল—হালকা, কিন্তু গভীর এক হাসি।
জান রুপের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে বলল,
—“তুমি দাঁড়াও আমি নিজেই নিয়ে আসছি।
বলে জান দোকানের দিকে চলে গেল।
জান দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানদার চমকে উঠল,
— “জান! তুমি এখানে? কিছু লাগবে বাবা?”
দোকানির কথা জান মৃদু হাসল,
— “লাগবে চাচা,তবে আপনার ব্যাস্ত হতে হবে না। আমি নিজেই নিচ্ছি।”
বলে জান,সামনে সাজানো ললিপপের ঝুড়ি থেকে দুটো তুলে নিল। তারপর টাকা বের এগিয়ে দিল দোকানির দিকে। দোকানদার থেমে বলল,
— “কি করছো বাবা! তোমার কাছ থেকে টাকা নেব?”
জান একটু হেসে বলল,
— “চাচা, এটা বিশেষ একজন আমাকে উপহার দিচ্ছে। তাই আমি চাই, ওর টাকাতেই জিনিস টা কিনতে। আপনি টাকা রাখুন।”
এই কথা বলতে বলতেই জান তাকাল বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রুপের দিকে।
রুপ লজ্জা আর বিস্ময়ে চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে। তবু তার চোখে স্পষ্ট একরাশ কৌতূহল।
দোকানদারও রুপের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “এই মেয়েটা কি তাহলে সেই বিশেষ কেউ?”
জান মাথা নাড়ল,
— “হুম আমার বিশেষ একজন বন্ধু। ওর দিকে খেয়াল রাখবেন চাচা।”
— “কেমন খেয়াল?
জান একটু হাসলো। দোকানদার সাথে সাথে বলল,
—“বুঝেছি বাবা,তুমি একদম চিন্তা করো না।
— “টাকা রাখুন চাচা আর কথা মনে রাখবেন ওর দিকে খেয়াল রাখবে ।”
চাচা বিশ টাকা রেখে বাকিটা ফেরত দিলেন। জান টাকা নিল এবং ফিরে গেল রুপের কাছে।
সে দুটো ললিপপের একটি রুপের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— “এই নাও, খেতে খেতে বাসায় যাও।”
রুপ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
— “আপনি সিগারেট নিলেন না?”
জান ললিপপের মোড়ক খুলে মুখে দিয়ে বলল,
— “তোমার উপহার দেওয়া ললিপপ দিয়েই নাহয় সিগারেটের নিপাত যাক । যদিও আরও তিন’দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি।”
রুপ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
— “তিন’দিন আগে মানে?”
—“তুমি যে সিগারেট টা ফেলে ছিলে সেটাই ছিল আমার শেষ সিগারেট। চাপা কন্ঠে বলল জান।রুপ ঠিকমত বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,
—“কি বললেন?
জান মুখে হাসি রেখে উত্তর দিল
— “কিছু না। এখন এত প্রশ্ন না করে বাসায় যাও। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের সঙ্গে বেশি কথা বললে তোমার মা রাগ করবেন…”
রুপ ধরা গলায় বলল,
— “আপনি কি আমার মাকে চেনেন…?”
জান কিছু বলল না। হেঁটে সরে যেতে লাগল ভিড়ের দিকে।
রুপ অপলক তাকিয়ে রইল—হাতের ললিপপ, মনে অজানা এক অনুভব।
চলবে…!