সিমরানের জীবন যেন এক অন্ধকার গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছে, যেখানে প্রতিটি পথ শুধু হতাশা আর অসহায়ত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন টাকার জন্য ছুটোছুটি করে সে ক্লান্ত, শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই, তবু তার মন হাল ছাড়েনি। ব্যাংকের নির্লিপ্ত কাউন্টার থেকে শুরু করে পরিচিত আত্মীয় স্বজন সবার দ্বারস্থ হয়ে সে সাহায্যের জন্য মিনতি করেছে। এমনকি তার কাছে থাকা কিছ্য পুরোনো গয়না—মায়ের শেষ স্মৃতি—তাও বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু ছয় লাখ টাকা? এই অঙ্ক তার কাছে এক অসম্ভব সংখ্যা। সে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ল কিন্তু হাসপাতালে বাবার কষ্টে কাতর মুখটি মনে পড়তেই তার বুক ফেটে কান্না পেল,সে থামল না।
দিন শেষে, টিউশন শেষ করে রাতের গাঢ় অন্ধকারে বাসার দিকে হাঁটছিল সিমরান। নির্জন রাস্তায় আলো আঁধারের মিশেল, দূরে কয়েকটি কুকুরের ডাক ভেসে আসছে,তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটি যেন পুরো পৃথিবীর ভার বহন করে চলেছে—সিমরান ধীর পায়ে হাঁটছে, তার মাথা নিচু, চোখে হতাশার ছায়া। হঠাৎ, পেছন থেকে একটি গাড়ির ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জন ভেসে এল। শব্দটি রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। সিমরান পিছনে তাকানোর আগেই ছায়ার মতো কয়েকটি কালো পোশাক পরা লোক তার দিকে ছুটে এল। তাদের মুখ ঢাকা ছিল, চোখে কঠিন দৃষ্টি।
__“কে আপনারা? আমাকে ছাড়ুন! প্লিজ!” সিমরান চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কণ্ঠ কাঁপছিল, ভয়ে দমে যাচ্ছিল। একজন তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরল, আরেকজন দ্রুত তার চোখে একটি কালো কাপড় বেঁধে দিল। অন্ধকার তার দৃষ্টিকে গ্রাস করল। সিমরান ছটফট করছিল, তার হাত-পা আঁকড়ে ধরে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু লোকগুলোর শক্তির সাথে পেরে উঠল না। তারা তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে দিল। তার বুকের ভেতর ভয়ে হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে যাচ্ছিল। কারা এরা? কেন আমাকে ধরছে? তার মন প্রশ্নে ভরে গেল, কিন্তু উত্তর পেল না। ঠিক তখনই গাড়ির ভিতরে একটই আলতো স্পর্শ তার দিকে এগিয়ে আসল। সে নরম হাতে সিমরানকে নিজের কাছে টেনে নিল।তারপর বলল,
__শান্ত হও সিমরান আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। সে সিমরানের ছটফটকে থামিয়ে দিয়ে সিমরানকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ গোঁজে দিল। সিমরানের মেরুদন্ডে হিম স্রোত বয়ে গেল। তার মনে হল তার কপালে কারোর ঠোঁট ছুঁয়েছে সিমরান পুরোপুরি বুঝার আগেই নাকে একটি তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধ এল,আর সবকিছু অন্ধকারে ডুবে গেল।
বেশ অনেক্ষন পর সিমরানের জ্ঞান ফিরল। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যেমন লাগে, সিমরান চোখ খুলে অবাক হল, চারপাশে মৃদু আলোর ঝাপসা অন্ধকার চোখে পড়ছে। সে বুঝতে পারল, সে একটি বিশাল বিছানায় শুয়ে আছে। বিছানার চাদর মসৃণ, সিল্কের মতো নরম, আর বাতাসে সুগন্ধ ভেসে আসছে।
সিমরান উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাত-পা দুর্বল লাগছে, যেন কেউ তার সমস্ত শক্তি চুষে নিয়েছে। তার মাথা ঘুরছে, বুকের ভেতর ভয় আর বিভ্রান্তি একসঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে।
__ আমি কোথায়? কারা আমাকে এখানে এনেছে? ওই লোকটি কে ছিল যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল? তার মন প্রশ্নের ঝড়ে ভরে গেল, কিন্তু কোনো উত্তর মিলল না।
সিমরান বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে চাইলো ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল দেয়ালে ঝোলানো একটি বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবির উপর। ছবিতে একজন পুরুষ—দামি স্যুটে সজ্জিত, চোখে তীক্ষ্ণ শিকারীর দৃষ্টি, ঠোঁটে একটি হালকা, রহস্যময় হাসি। সিমরানের শ্বাস আটকে গেল। অরণ্য চৌধুরী!
তার মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেই রাতের স্মৃতি ফিরে এল—অরণ্যের অস্থির, তীব্র চোখ, তার শক্ত মুঠির আঁকড়ে ধরা, আর তার ফিসফিসে কণ্ঠে বলা কথা: “তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, তাই না?” সিমরানের হাত কাঁপতে শুরু করল। তার বুকের ভেতর ভয় আর বিস্ময়ের ঝড় বয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এই অন্ধকার ঘর, এই রাজকীয়তা—সবই অরণ্যের। কিন্তু কেন? কেন সে তাকে এভাবে তুলে এনেছে? তার মনের ভেতর এক অজানা আশঙ্কা জেগে উঠল, যেন সে একটি অন্ধকার জালের মধ্যে আটকা পড়েছে, যার প্রতিটি সুতো তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সিমরানের চোখ ধীরে ধীরে ঘরের অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। সে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করল, কিন্তু তার শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছিল, যেন শরীরের সমস্ত শক্তি কেউ শুষে নিয়েছে। ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ ভেসে এল। সিমরান দরজার দিকে তাকাল। ঘরের বিশাল দরজা ঠেলে ধীরে এবং নিয়ন্ত্রিত পায়ে ঘরে ঢুকল অরণ্য। তার পরনে কালো সিল্কের শার্ট, যা তার শক্তিশালী, পুরুষালি দেহের রেখাগুলোকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। চোখে সেই পরিচিত তীব্রতা, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে কোনো অন্ধকার রাজ্যের শাসক।
অরণ্য এগিয়ে এসে সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
__“ঘুম কেমন হল, মিস সিমরান?”
সিমরান পিছিয়ে গেল, তার পা বিছানার কিনারায় ঠেকল, গলা কেঁপে উঠল,
__“আ… আপনি? তার মানে, আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন?”
অরণ্য উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। সিমরান চেঁচিয়ে বলল,
__“এটা কী ধরনের অসভ্যতা? আমাকে এভাবে তুলে আনার মানে কী?”
অরণ্য নিজের দৃষ্টি সিমরানের ওপর স্থির রেখে বলল,
__“শান্ত হও, সিমরান। তোমার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য আমার নেই। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল, কিন্তু তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলে, তাই… তোমাকে তুলে আনতে বাধ্য হয়েছি।”
সিমরানের চোখে জল টলটল করে উঠল। সে চিৎকার করে বলল,
__“আপনি কি মানসিক রোগী? হিতাহিত জ্ঞান নেই? ন্যায়-অন্যায় বোঝেন না? কোন সাহসে আপনি আমাকে তুলে এনেছেন?”
অরণ্য কিছুটা রেগে বলল,
__“তোমাকে আমি শান্ত হতে বলেছি, সিমরান! চিৎকার করে কোনো লাভ নেই। তোমার চিৎকারে আমার উদ্দেশ্য বদলাবে না।”
__“শান্ত হব?” সিমরানের কণ্ঠে ক্রোধ মিশে গেল। “আমার বাবা হাসপাতালে জীবন-মরণের সঙ্গে লড়ছে, আর আপনি… আমাকে জোর করে তুলে এনেছেন! এরপরেও আমি শান্ত থাকব?”
অরণ্যের কণ্ঠে কঠোরতা ফুটে উঠল।
__“হ্যাঁ, থাকবে। কারণ তুমি এখন আমার হাতে বন্দী, তাই আমি যা বলব, তোমাকে তাই করতে হবে। আর আমি উচ্চস্বরে কথা বলা একদম পছন্দ করি না। তাই এমন কিছু করো না, যা তোমার ক্ষতির কারণ হয়ে উঠে।”
সিমরানের চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল, তবু সে হাল ছাড়ল না।সে ফিসফিসিয়ে বলল,
__“সেই রাতে আমি আপনাকে সাহায্য করতে ছুটে এসেছিলাম, তার বিনিময়ে আপনি আমার পিছনে লেগেছেন? উপকারের এই প্রতিদান দিচ্ছেন? আপনার ভেতরে কি মানবতা বলতে কিছু নেই? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি? আমাকে এভাবে তাড়া করার কারন কী?”
অরণ্য এক পা এগিয়ে এসে, তার চোখে তীব্র দৃষ্টি রেখে বলল,
__“কারণ আমি তোমাকে নিজের করে পেতে চাই।
অরণ্যের কথায় সিমরানের শরীর যেন বরফ হয়ে গেল। পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু বিছানার কিনারা তার পশ্চাদপসরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। ঘরের মৃদু আলো অরণ্যের মুখে পড়ে তার দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলল। অরণ্যকে দেখে মনে হচ্ছে সে একজন নিখুঁত শিকারী, যে এই মুহূর্তে তার শিকারকে কোণঠাসা করে ফেলেছে।
অরণ্য ধীর পায়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে এল। তার কণ্ঠে একটা ঠান্ডা, নিয়ন্ত্রিত সুর বেজে উঠল,
__“সিমরান, তুমি সত্যিই আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ না?” সে মাথা কাত করে তাকাল, যেন সিমরানের ভয়টাকে উপভোগ করছে। “আমি সেদিন বলার পরেও তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। কি ভেবেছিলে, আমি তোমাকে এত সহজে ছেড়ে দেব?”
সিমরানের গলা শুকিয়ে গেল। সে ঢোক গিলে কোনোরকমে বলে উঠল,
__“আপনি… আপনি এসব কী বলছেন? আমি আপনার কেউ নই!আমাদের দেখা হওয়াটা শুধুমাত্র একটা কাকতালীয় ঘটনা। আপনি আমার সাথে এমন করতে পারেন না। আমাকে ছেড়ে দিন, প্লিজ।”
অরণ্য হাসল, এবার তার হাসিতে একটা নিষ্ঠুরতার আভাস ফুটে উঠল। সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
__“ছেড়ে দেব? তোমাকে এখানে তুলে এনেছি কি ছেড়ে দেওয়ার জন্য? আর কে বলল তুমি আমার কেউ না? এই ঘর, এই মুহূর্ত—এমনকি তুমি, সবকিছু এখন আমার নিয়ন্ত্রণে।”
সিমরানের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে শুরু করল। সে ঘরের চারপাশে তাকাল, পালানোর পথ খুঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু জানালাগুলোতে লোহার গ্রিল, আর দরজাটা অরণ্যের পেছনে বন্ধ। সে কাঁপা গলায় বলল,
__“এমন পাগলামির কোনো মানে হয় না! আপনি আমাকে নিয়ে খেলতে পারেন না। আমাকে যেতে দিন, প্লিজ। আমার বাবা হাসপাতালে, আমাকে যেতে হবে।”
অরণ্যের ভ্রূ কুঁচকে গেল, কিন্তু তার চোখে কোনো সহানুভূতি ছিল না। সে এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়াল, তার উপস্থিতি যেন ঘরের বাতাসকে ভারী করে তুলল।
__“তোমার বাবার কথা বারবার বলে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।”
সিমরান চিৎকার করে উঠল,
__“আপনি প্লিজ মানসিক ডাক্তার দেখান। আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন। আপনি কী বলছেন, কী চাইছেন, হয়তো নিজেই জানেন না।অমানুষের মত আচারন করছেন কেন?”
কথা শেষ করার আগেই অরণ্য দ্রুত সিমরানের হাত ধরে টেনে নিল। তার শক্তিশালী হাতের মুঠিতে সিমরানের কবজি আটকে গেল। সিমরান হকচকিয়ে উঠল, তার চোখে ভয় আর অসহায়ত্ব ঝলসে উঠল। অরণ্যের শক্তি এতটাই ছিল যে সিমরান ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। অরণ্যের চোখে ভয়ংকর শীতলতা ফুটে উঠল। সে ধমকে বলল,
__“চুপ। তুমি আমাকে অমানুষ বলো, যা খুশি বলতে পারো, কিন্তু এই অমানুষই এখন তোমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। তুমি যতই চিৎকার করো, এখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।”
সিমরান তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অরণ্যের শক্তির সঙ্গে পেরে উঠল না। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
__“আপনি যা করছেন, ঠিক করছেন না। এর জন্য আপনি পস্তাবেন। আমাকে ছেড়ে দিন, নইলে—”
__“নইলে কী?” অরণ্যের কণ্ঠে বিদ্রূপ ঝরে পড়ল। সে সিমরানের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে আনল, তার গরম নিঃশ্বাস সিমরানের গালে লাগছিল।
__“তুমি কিছুই করতে পারবে না, সিমরান।”
রাগে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল, সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
__“দেশে আইন-কানুন এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।”
__“তাই নাকি? ঠিক আছে, দেখা যাক, মিস সিমরান। সময় এখন কার পক্ষে কথা বলে? তোমার বাবা হাসপাতালে, তাই না? চিকিৎসার খরচ ছয় লক্ষ টাকা, তাই তো?
__”আপনি জানলেন কি করে?
__” আমি কি করে জানলাম সেটা জানা জরুরী নাকি টাকা জোগাড় করা জরুরী? তুমি একা, কীভাবে সামলাচ্ছ এত কিছু?
__”কি বলতে চাইছেন?
__” তুমি চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
সিমরানের চোখে বিস্ময় আর অবিশ্বাস ফুটে উঠল, চোখ দুটি স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিল অরণ্যের দিকে, যেন তার কথাগুলো মনের গভীরে ধাক্কা দিয়ে গেছে।
__“কী বলছেন? আপনি সত্যি আমাকে সাহায্য করবেন? কিন্তু কেন? তার কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর স্পষ্ট।
অরণ্যের ঠোঁটে একটা শান্ত, আত্মবিশ্বাসী হাসি খেলে গেল। সে গভীর দৃষ্টিতে সিমরানের চোখে তাকিয়ে বলল,
__“হ্যাঁ, অবশ্যই সাহায্য করব। আমি এখনই সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি। হাসপাতালের বিল, তোমার বাবার চিকিৎসা—সবকিছু। কিন্তু…” পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই সে থামল, যেন কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে শব্দগুলো আটকে রাখল।
সিমরানের ভ্রু কুঁচকে গেল। তার হৃৎপিণ্ডে একটা অজানা আশঙ্কা জেগে উঠল।
__“কিন্তু কী?”
অরণ্যের চোখে এক শিকারীর দৃষ্টি জ্বলে উঠল, সে ধীরে ধীরে বলল,
__“আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেব। তার বিনিময়ে আমি কী পাব?”
সিমরানের শ্বাস যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার গলা শুকিয়ে এল, কথা আটকে গেল গলায়। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বলল,
__“কী… কী চান আপনি?”
অরণ্য ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। তার প্রতিটা পদক্ষেপে একটা অদ্ভুত ছন্দ বেজে উঠল, যেন সে শিকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সিমরানের কাছে এসে সে দাঁড়াল,
__“তোমার বয়স কত?
সিমরান বেশ ইতস্তত করে বলল,
__”উনিশ কিন্তু কেন?
__” তারমানে প্রাপ্ত বয়স্ক,so you’re legally and emotionally mature enough for a physical relationship.”
অরণ্যের বলা কথাটা শুনে সিমরানের হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। তার কণ্ঠ ভেঙে গেল সে ভীতু চোখে তাকিয়ে বলল,
__“ম-মানে?” তার চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট, হাত দুটি সজোরে নিজের ওড়না আঁকড়ে ধরল, যেন ওই পাতলা কাপড়টাই এখন তার প্রতিরোধের একমাত্র অবলম্বন।
অরণ্য তার ওড়নার দিকে একবার তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তার হাসিতে একটা নির্মম আত্মবিশ্বাস রয়েছে,
__”মানে আমি চাই তুমি আমার ব্যাক্তিগত সঙ্গী হিসেবে থাকো।
__”আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছেন?
__“মানেটা না বুঝার মত ছোট তো তুমি নও।তাও যখন শুনতে চাচ্ছো সরাসরি বলি আমি চাই তুমি আমার মনোরঞ্জন করো মানে তুমি আমার শারীরিক চাহিদা পূরণ করবে বিনিময়ে আমি তোমাকে টাকা দিব।
কথাগুলো শুনে সিমরানের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। তার হাত নিজে থেকেই উঠে গেল, এবং ঠাস করে অরণ্যের গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিল। শব্দটি ঘরের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। কিন্তু অরণ্য একটুও বিচলিত হল না। তার মুখে সেই রহস্যময় হাসি অটুট রইল, যেন সে সিমরানের এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সে জানত এমন কিছু ঘটবে।তার চোখে রাগের বদলে অদ্ভুত এক নিশ্চয়তা ফুটে যেন সে আগে থেকেই জানে এই খেলায় সে জিতবেই।
সিমরান চিৎকার করে উঠল, তার কণ্ঠে রাগ, ভয় আর অসহায়ত্ব মিশে গেল।
__“আপনি নিজেকে কী ভাবেন? এমন একটা ঘৃণ্য প্রস্তাব দেওয়ার আগে আপনার বুক কাঁপল না?আপনি কি ভাবেন টাকা দিয়ে সব কেনা যায়? শুনুন, মিস্টার অরণ্য চৌধুরী,আপনি আমাকে কি ভেবেছেন আমি জানি না কিন্তু আমি ওই রকম মেয়ে নই।
অরণ্য কিছুটা তাচ্ছিল্য নিয়েই বলল,
__”আমি তোমাকে কোন রকম মেয়ে ভাবিও নি।
__”তাহলে এমন একটা প্রস্তাব কি করে দিলেন?
__” দিয়েছি কারন তোমার এখন টাকা দরকার।
__” আপনি আমাকে চিনতে ভুল করেছেন সব মেয়ে টাকার কাছে বিক্রি হয় না। আমি গরিব হতে পারি, কিন্তু নিজের সম্মান বিক্রি করব না! খবরদার আপনি আর কখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।”
অরণ্য কোনো জবাব দিল না। শুধু সিমরানের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন সে তার প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি দুর্বলতা পরিমাপ করছে। ধীরে ধীরে সে সিমরানের আরও কাছে এগিয়ে এল। সিমরান পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দেয়াল তার পিঠে ঠেকে গেল। অরণ্য দ্রুত তার হাত ধরে টেনে নিল। সিমরান হকচকিয়ে উঠল, তার চোখে ভয় আর অসহায়ত্ব ঝলসে উঠল। পরক্ষণেই অরণ্য তাকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস সিমরানের ঘাড়ে আছড়ে পড়ল, তার শরীর কেঁপে উঠল।
__”কি করছেন এসব?
অরণ্য সিমরানের কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
__“আমি যা চাইছি, আমি চাইলে এখনী জোর করে আদায় করে নিতে পারি। এটা আমার সাম্রাজ্য এখানে আমাকে বাধা দেওয়ার সাহস কারোর নেই। কিন্তু আমি তা করব না। আমি চাই তুমি নিজের ইচ্ছায় রাজি হও। ভেবে দেখো, তোমার কাছে কোনটা বেশি দামি—তোমার সম্মান, নাকি তোমার বাবার জীবন?”
অরণ্যের কথায় ঘরের বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। সিমরানের চোখে ভয় আর অসহায়ত্ব একসঙ্গে জমাট বাঁধল। তার হাত কাঁপছে, ওড়নার কোণা আরও শক্ত করে চেপে ধরল সে। অরণ্যের দৃষ্টি তার উপর স্থির, যেন সে সিমরানের প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি দ্বিধা পড়ে ফেলছে।
সিমরানের মনে ঝড় উঠল। তার বাবার মুখ, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা অসহায় শরীর, আর এই মুহূর্তের এই অন্ধকার প্রস্তাব—সব মিলে তাকে যেন এক অতল গহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে কী জবাব দেবে?
সিমরানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। তার কণ্ঠ ভেঙে গেল।
__“আপনি কি মানুষ? আমার বাবা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, আর আপনি আমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করছেন?”
অরণ্য তার মুখের কাছে আরও ঝুঁকে পড়ল, তার নিঃশ্বাস সিমরানের গায়ে এক শীতল শিহরণ জাগিয়ে তুলল।
__“ব্ল্যাকমেইল?” “না, আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করছি না, বরং আমি তোমাকে একটি সুযোগ দিচ্ছি। তুমি জানো, এত কম সময়ে তুমি এতগুলো টাকা জোগাড় করতে পারবে না। তাই আমি তোমাকে এই সুযোগটা দিচ্ছি।”
সিমরান ছটফট করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অরণ্যের শক্তি তার কাছে অপ্রতিরোধ্য ছিল।
__“একটা মানুষ এত নীচে কীভাবে নামতে পারে?” আমার বাবার জীবন নিয়ে আপনি এমন কুৎসিত দর-কষাকষি করছেন? আপনি কী ধরনের মানুষ?”
__“মানুষ?সে হাসল, ঠান্ডা, নিষ্ঠুর হাসি। “আমি সেই মানুষ, যে জানে কীভাবে নিজের চাওয়া পূরণ করতে হয়। অরণ্য চৌধুরীর নজর একবার যে জিনিসের উপর পড়ে, সেই জিনিস পাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই নজর আর সরে না। তবে আমি তোমাকে জোর করব না। আমি শুধু একটা প্রস্তাব দিয়েছি। তুমি চাইলে সেটি গ্রহণ করতে পারো, অথবা উপেক্ষা করতে পারো। প্রস্তাব মেনে নিলে তোমার বাবা বাঁচবেন,বিনিময়ে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। এটা এত জটিল কোনো বিষয় নয়।”
সিমরানের ভেতরটা কেঁপে উঠল, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। তবুও সে মাথা তুলে বলল,
__“আপনাদের মত বড়লোকদের সমস্যা কি জানেন? আপনারা ভাবেন টাকার বিনিময়ে সব পাওয়া যায়। আপনি ভাবছেন আমি বিপদে পড়েছি জন্যে এমন একটা জঘন্য প্রস্তাব মেনে নেব, আমার বাবার জীবনের জন্য আমি নিজের সম্মান বিক্রি করব কিন্তু জেনে রাখুন আপনি আমাকে যতই ভয় দেখান, আমি আপনার কাছে মাথা নত করব না।”
সিমরানের কথায় অরণ্যের চোখ সংকুচিত হয়ে গেল, তার মুখে একটা কঠিন রেখা ফুটে উঠল।
__“দেখা যাক, আমি অপেক্ষা করব, কিন্তু মনে রেখো, আমার ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। যাই হোক, তোমার হাতে কাল সকাল পর্যন্ত সময় আছে। ডাক্তার বলেছে, কালকের মধ্যে অপারেশন করতে হবে। ভেবে দেখো, বাবার জীবন, নাকি তোমার সম্মান—কোনটা বেছে নেবে?”
সিমরান কোনো জবাব দিতে পারল না। তার মনের ভেতর যুদ্ধ শুরু হয়েছে—বাবার জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব আর নিজের সম্মান বাঁচানোর যুদ্ধের মধ্যে সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। অরণ্য সিমরানের নীরবতার মধ্যে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি খুঁজে পেল। সে হঠাৎ তার কণ্ঠ নরম করে বলল,
__“এত ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি জোর করে কিছু করব না।” তার কথায় একটা মিথ্যা আশ্বাসের আভাস ফুটে উঠল, যা সিমরানের মনের দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তুলল অরন্য শান্ত গলায় বলল,
__“তুমি এখন যেতে পারো।বাসায় গিয়ে ভালো করে ভেবে সিধান্ত নাও, তুমি আসলে কি চাও?তারপর আমাকে জানিয়ে দিও”
সিমরান কিছু না বলে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল, তার হৃৎপিণ্ড তখনও দ্রুত লাফাচ্ছিল। কিন্তু সে দরজায় পৌঁছানোর আগেই অরণ্য আবার বলে উঠল,
__“দাঁড়াও। রাত হয়ে গেছে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
সিমরান থমকে দাঁড়াল। তার মন বলছিল এই প্রস্তাবটাকেও প্রত্যাখ্যান করতে, কিন্তু তার শরীরে আর কথা বলার শক্তি ছিল না। তাছাড়া এত রাতে একা একা যেতেও পারবে না। তাই সে চুপচাপ অরণ্যের পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। অরণ্য নিজের গাড়ি করে সিমরানকে বাড়ি পৌঁছে দিল। পুরো পথে সিমরান একটি কথাও বলল না, তার চোখ জানালার বাইরে স্থির ছিল। সারা রাস্তায় অরণ্য কিছু না বললেও গাড়ি যখন সিমরানের বাড়ির দরজার সামনে থামলো অরণ্য ঠান্ডা গলায় বলল,
__”তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না, কেন একজন অচেনা ছেলে, তোমাকে এমন প্রস্তাব দিচ্ছে?
__”আমার জানার দরকার নেই, দুশ্চরিত্র ছেলেদের অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা করে।
__”তবুও শহরে এত মেয়ে থাকতে, তুমিই কেন?”
অরণ্যের কথাগুলো যেন বিষাক্ত তিরের মতো সিমরানের বুকে বিঁধল। তার কণ্ঠে একটা রহস্যময় আভাস,