Mdigitech

Oronner Chaya Megh Part 12

অরণ্য আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল
যেখানে এক চুপ থাকা মেয়ের চোখে অনির্বচনীয় কিছু প্রশ্ন দোল খাচ্ছে। দুজনের কারোর মুখেই কোন কথা নেই। চারদিকে যেন পিনপতন নীরবতা।সেই নিরবতা ভাঙল অরণ্য নিজেই। গলার স্বর নরম, কিন্তু ভারী—
— “তুই ভাবছিস, আমি ঠিক কী চাই… তাই না?”
সিমরান চমকে উঠল।
সে কিছু বলেনি, কিছু প্রকাশও করেনি, তবু কীভাবে অরণ্য ঠিক আন্দাজ করে ফেলল তার ভাবনার গভীরতা?
সিমরান অরণ্যের কাছে হারতে চায় না তাই তাড়াতাড়ি বলল,
__”আমি কিছু ভাবছি না। আপনি আসুন আমি নিচে যাচ্ছি আপনার খাবার গুছিয়ে দিচ্ছি।

__”এই তো কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখছি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিস। কখন কি করতে হবে নিজেই বুঝে গিয়েছিস।

__”আমি কি তবে যেতে পারি?

__”একা একা যেতে পারবি নাকি আমি নিয়ে যাব? পায়ের ব্যাথাটা…

পুরো কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে সিমরান বলে উঠল। নিজেই যেতে পারব পায়ে ব্যাথা করছে না। বলেই এক ছুটে বেরিয়ে গেল। সিমরানের কান্ডে অরণ্যের মুখে হাসি ফুটলো।
সে উঠে দাঁড়াল, তার স্যুট পরতে শুরু করল।

সিমরান রান্নাঘরে ফিরে এসে আবার আটা মাখতে শুরু করল। তার হাত যান্ত্রিকভাবে চলছিল, কিন্তু তার মন অন্য কোথাও। অরণ্যের নিষ্ঠুর আচরণ—তার হিংস্র স্পর্শ, তার কর্কশ কথা, আর তার অদ্ভুত যত্নের মুখোশ—সবকিছু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিকে তার মনে হচ্ছিল, অরণ্য তাকে একটা বন্দী পুতুলের মতো ব্যবহার করছে; অন্যদিকে তার পায়ের ব্যথার খোঁজ নেওয়া, মলম লাগিয়ে দেওয়া তাকে বারবার নিজের কাছে টানার  মতো আচরণ তাকে বিভ্রান্ত করছিল। এই দ্বৈততা তার মনের ভেতর একটা তীব্র ঝড় তুলছিল—অরণ্য কি সত্যিই তার কষ্ট বোঝে, নাকি এটাও তার নিয়ন্ত্রণের আরেকটি খেলা?

সে রুটি বেলতে শুরু করল, পাশে একটা পাত্রে সবজি রান্না হচ্ছে। বাতাসে সবজির মশলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সিমরানের মনে কোনো স্বস্তি নেই। নাজমা মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে সাহায্য করছে—কখনো পাত্রে জল ঢেলে দিচ্ছে, কখনো মশলা এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সিমরানের নীরব ফ্যাকাশে মুখ দেখে নাজমা বুঝতে পারছিল, এই মেয়ের মনে একটা গভীর ঝড় চলছে। নাজমা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মৃদু হেসে নিজের কাজে মন দিল।

কিছুক্ষণ পর মার্বেলের মেঝেতে অরণ্যের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হল। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সিমরানের বুকের ভেতর একটা অজানা ভয় জাগিয়ে তুলছে। অরণ্য খাবার টেবিলে এসে বসল, তার চোখে একটা শান্ত, কিন্তু ভয়ঙ্কর দৃষ্টি। সে সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
__“সিমরান, আমার জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানা। শিগগির।”

সিমরানের হাত থমকে গেল। সে রান্নাঘরের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে রুটির বেলন। তার মনে হল, অরণ্য তাকে একটা যান্ত্রিক রোবটের মতো ব্যবহার করতে চাইছে যার কোন অনুভুতি নেই। কিন্তু সে কিছু বলল না। মাথা নিচু করে কফি মেশিনের দিকে এগিয়ে গেল। নাজমা তাকে দেখিয়ে দিল কফির পাউডার আর মেশিন কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। সিমরান কফি তৈরি করতে লাগল,

কফি তৈরি করে সে অরণ্যের সামনে টেবিলে রাখল। অরণ্য কাপে চুমুক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
__“কি বানিয়েছিস এটা?

সিমরান হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
__”কি হয়েছে? আমি তো ঠিকঠাক মতই বানিয়েছিলাম।

__”ঠিকঠাজ মত? তাহলে এত মিষ্টি হয়েছে কেন? দেখ সিমরান, আমি কী পছন্দ করি আর কী করি না তোকে সব জানতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি তা আয়ত্ত করতে পারবি তোর জন্য ততই মঙ্গল। যাইহোক আজ প্রথমবার তাই ছাড় দিলাম। যা, চিনি ছাড়া আবার বানিয়ে আন।”

অরণ্যের কথায় সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার মন চিৎকার করে বলতে চাইল, “আমি আপনার দাসী নই!” কিন্তু তার গলা দিয়ে কথা বের হল না। তার চোখে অশ্রু জমা হল, কিন্তু সে তা লুকিয়ে রাখল। সে চুপচাপ কফি কাপ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেল। নাজমা তার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, “ম্যাডাম, আমি তো আগেই বলেছিলাম, ছোট সাহেব মিষ্টি একদম পছন্দ করেন না।”

সিমরান কিছুটা রাগ নিয়েই বলে উঠল,
__”হ্যা আমারেই ভুল আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল উনার মত তেতো লোকের মিষ্টি পছন্দ হবে না।

সিমরানের কথা অরণ্যের কান এড়ায়নি তবে সে রাগ করেনি শুধু সিমরানকে ভয় দেখানোর জন্য বলল,
__”কিছু কি বললি?

সিমরান মাথা নাড়ল, তাড়াতাড়ি বলল
__” কিছু বলিনি আমি!
সে আবার কফি তৈরি করতে লাগল, কফি তৈরি করে সে টেবিলে ফিরে এল। অরণ্য এবার চুমুক দিয়ে সন্তুষ্ট হল। সে বলল,
__”আরেকটা কথা। আমি চলে যাবার পর বাবার জন্য এক কাপ চা বানাবি। দুধ দিয়ে, চিনি কম। তারপর বাবার ঘরে গিয়ে দিয়ে আসবি। তিনি তোকে খুব একটা পছন্দ করবেন না, জানি, কিন্তু তার মন জয় করার দায়িত্ব তোর।”
অরণ্যের কথা শুনে সিমরানের মনে একটা তীব্র প্রশ্ন জাগল
—”সে কেন কারও মন জয় করতে যাবে? তাকে কেন এই সব করতে হবে? কিন্তু প্রশ্নটা তার গলায় এসে আটকে গেল। তার মনে পড়ল অরণ্যের বলা কথা—“আমার চাহিদা মেটানোর জন্যই তোকে এনেছি।” তার শরীর কেঁপে উঠল। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। অরণ্য আবার বলল,
__“নাস্তায় কী করেছিস?”
সিমরান নিচু স্বরে উত্তর দিল,
__“রুটি, সবজি।”
অরণ্য হাসল, তার হাসিতে একটা নিষ্ঠুর তৃপ্তি। __“তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? খাইয়ে দে।”
সিমরানের চোখে বিস্ময় আর অপমানের ছায়া ফুটে উঠল। তার মনের ভেতর আবার সেই ক্ষীণ প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠল। সে আর চুপ থাকতে পারল না। কাঁপা কণ্ঠে বলল, __“খাইয়ে দিতে হবে কেন? আপনি নিজে খেতে পারেন না? আমি… আমি আপনার দাসী নই। আমি এসব করতে পারব না।”
অরণ্যের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। ঘরের বাতাস যেন এক মুহূর্তে ভারী হয়ে উঠেছে। সে  ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, তার উপস্থিতি যেন সিমরানকে ভয় পায়িয়ে দিল তার কণ্ঠে রাগ ঝরে পড়ল,
__“কী বললি?”

অরণ্যের ধমকে সিমরান কেঁপে উঠল কিন্তু তার মনের ভেতর প্রতিবাদের আগুন আরও জ্বলে উঠল। সে বলল,
__“আমি বললাম, আমি এসব অবান্তর কাজ করতে পারব না। আমাকে এভাবে অপমান করার কোনো অধিকার নেই আপনার।”

অরণ্য এবার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।  সে টেবিলের প্লেটটা তুলে সজোরে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। প্লেটটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মার্বেলের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। রুটি আর সবজি মেঝেতে ছিটকে পড়ল, যেন সিমরানের শ্রমের প্রতিটি টুকরো ধ্বংস হয়ে গেল। সিমরান হকচকিয়ে পিছিয়ে গেল, তার মুখে ভয় আর বিস্ময় স্পষ্ট হয়ে উঠল।
অরণ্য ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল,তারপর সিমরানের থুতনি চেপে ধরে বলল,
__“তোকে এক কথা আমি বারবার বুঝাতে পারব না তুই ভুলে যাস না, এখানে থাকতে হলে আমি যা বলব, তুই তাই করবি। তা নাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে তোর কী কী ক্ষতি হবে, তুই ভালো করেই জানিস।”

Oronner Chaya Megh Part 1

Oronner Chaya Megh Part 2

Opurno Prem Part 1

Aboddho Prem Part 1

Bangla Love Story Collection

সিমরানের হৃৎপিণ্ড যেন থেমে গেল। তার মনে পড়ল তার বাবার অসুস্থ মুখ, তার চিকিৎসার জন্য অরণ্যের দেওয়া টাকা। তার শরীর অবশ হয়ে গেল, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে মাথা নিচু করে ফিসফিস করল,
__“আমি… আমি দুঃখিত। আর কখনো এমন করব না”

অরণ্য সিমরানের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, তার কালো স্যুটের নিখুঁত ভাঁজে সকালের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। সে দরজার কাছে গিয়ে একটু থামলো তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দুজন গার্ডের দিকে তাকিয়ে সে কঠোর কণ্ঠে বলল, __“ম্যাডামের ওপর নজর রাখবে। বাড়ির বাইরে যেন পা না রাখতে পারে। বুঝেছ?”

গার্ডরা তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল, তাদের মুখে কোনো আবেগ নেই, শুধু কর্তব্যপরায়ণতার ছায়া ফুটে উঠল। অরণ্য আরেকবার সিমরানের দিকে তাকাল। তবে সেই চাহনীতে নিষ্ঠুরতা মিশে আছে।
__“আমি অফিসে যাচ্ছি,আমি যাওয়ার পর খেয়ে নিবি আর বাবাকেও ঠিক মতো খাবার দিবি।ফিরে এসে যেন না শুনি তুই নতুন কোন গন্ডোগোল করেছিস।

বলেই সে বেরিয়ে গেল। তার পায়ের শব্দ করিডরের মার্বেল মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সিমরান দাঁড়িয়ে রইল তার চোখ থেকে আবারো অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো কিন্তু সে তা মুছে ফেলার চেষ্টাও করল না। তার মনে হচ্ছিল, সে একটা অদৃশ্য খাঁচায় বন্দী, যার দেয়ালগুলো অরণ্যের নির্দেশ আর হুমকি দিয়ে তৈরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top