সেদিন রাত প্রায় নয়টা। টিউশন শেষ করে বেরোতেই আকাশের গা-জোয়ারি গর্জনে ভিজে উঠল শহর। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হল দমকা বাতাস আর ঝমঝমে বৃষ্টি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে রিকশার খোঁজ করতে লাগল সিমরান, কিন্তু রাস্তায় যেন সময় থমকে গেছে—কোনো যানবাহনের দেখা নেই।
বাধ্য হয়ে সে একটি বাড়ির কার্নিশের নিচে আশ্রয় নিল। কিন্তু বৃষ্টির তীব্রতা দেখে বুঝতে পারল, এই ঝড় থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ভেজা শরীরে হাঁটা শুরু করল। ঠিক তখনই চোখে পড়ল, তার থেকে কিছুটা দূরে একটি ছেলে রাস্তায় বসে আছে। পরনে দামি স্যুট, পাশে বিলাসবহুল গাড়ি। মাথা নিচু, ভেজা চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে আছে। তাকে দেখে কোনোভাবেই পাগল মনে হয় না। তাহলে বৃষ্টির মধ্যে বসে কী করছে? কৌতূহল জাগল সিমরানের। সেই কৌতূহল তাকে ছেলেটির কাছে টেনে নিয়ে গেল।
সিমরান নিচু হয়ে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
—“আপনার কী হয়েছে? ঠিক আছেন তো?”
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি মাথা চেপে ধরে আর্তনাদ করে বলল,
—“প্লিজ, কেউ কাছে আসবে না… আমাকে একা থাকতে দাও!”
তার অবস্থা দেখে সিমরানের বুক কেঁপে উঠল। সে উদ্বিগ্ন গলায় আবার বলল,
—“আপনি কি মাথায় আঘাত পেয়েছেন? কোথাও ব্যথা করছে? আমাকে বলুন, আমি সাহায্য করতে চাই!”
ছেলেটি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সিমরানকে টেনে নিল। তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সিমরান। হকচকিয়ে উঠল সে। ভেজা শরীর, শীতল বাতাস, আর একজন অচেনা ছেলের এমন আচরণ—সব মিলিয়ে সিমরান যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটি তার কাঁধে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলল,
—“আমার খুব ভয় করছে… প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যেও না… তুমি চলে গেলে আমি… আমি হারিয়ে যাব!”
সিমরানের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল। ছেলেটি ভয়ে কাঁপছে, তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। তার কণ্ঠে এমন এক আর্তনাদ, যেন সে জীবনের শেষ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। সিমরান নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
—“ঠিক আছে, যাব না। ভয় পাবেন না। আমি এখানেই আছি। আমাকে বলুন, আপনার কী হয়েছে? আমি সত্যিই আপনাকে সাহায্য করব।”
ছেলেটি অস্পষ্টভাবে বলল,
—“এসব বন্ধ করো, প্লিজ… আমি আর নিতে পারছি না!”
সিমরান বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কী বন্ধ করব,কী বন্ধ করার কথা বলছেন?
ছেলেটি মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল,
—“বৃষ্টি বন্ধ করো! এই শব্দ, এই অন্ধকার…আমি আর নিতে পারছি না! প্লিজ, আমাকে বাঁচাও!”
সিমরান বুঝতে পারল না, বৃষ্টি কীভাবে বন্ধ করবে। তার অস্থিরতা দেখে সিমরানের মনের ভেতর অস্বস্তি আর করুণা একসঙ্গে জড়িয়ে গেল। ঠিক তখনই আরেকজন ছেলে ছুটে এল, সঙ্গে একজন ড্রাইভার। ছেলেটি উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠল,
—“অরণ্য! শান্ত হ, দোস্ত! সব ঠিক আছে। চল, বাসায় চল!”
কিন্তু অরণ্য তার কথায় কান দিল না। সিমরানকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সিমরানের বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। অরণ্য তাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে, যেন সে তার শেষ ভরসা। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে রাস্তাটা আরও নির্জন মনে হচ্ছিল। সিমরানের ভেজা কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে,অরণ্যের উষ্ণ নিশ্বাস তার কাঁধে আছড়ে পড়ছে। সে বুঝতে পারছে না, এই অচেনা ছেলেটির এমন আচরণের পিছনে কী কারণ। তবু তার মনের এক কোণে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগল—ভয়, কৌতূহল, আর অস্বস্তির মিশ্রণ।
অরণ্যের সঙ্গে সিমরানকে এই অবস্থায় দেখে নতুন ছেলেটি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“ম্যাডাম কে? ওনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
ড্রাইভার জবাব দিল,
—“আমিও চিনি না, স্যার। বৃষ্টি শুরু হতেই অরণ্য স্যার গাড়ি থেকে নেমে আগের মতোই অস্থির হয়ে উঠলেন। আমি তখন আপনাকে ফোন করতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি একাই ছিলেন।”
সিমরান কিছু বলতে চাইল, কিন্তু অরণ্য তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সে কিছু বলতে পারল না, শুধু মনে মনে ভাবল, *এ কোন মসিবতে পড়লাম?* সে বুঝতে পারল, অজান্তেই সে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। অরণ্য তাকে ছাড়তে রাজি নয়, সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। সিমরান নতুন ছেলেটির দিকে তাকাল। ছেলেটি অরণ্যকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
—“অরণ্য, শান্ত হ। সব ঠিক আছে। চল, গাড়িতে ওঠ।”
অরণ্য মাথা নাড়ল, কিন্তু সিমরানকে ছাড়ল না। তার হাতের মুঠি আরও শক্ত হল। সিমরান অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেল। সে আবার চেষ্টা করল নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে, কিন্তু অরণ্যের শক্তির কাছে পেরে উঠল না। ছেলেটি এবার সিমরানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
—“আপনি কে? এখানে কী করছিলেন?”
সিমরান তাড়াতাড়ি বলল,
—“আমি… আমি সিমরান, সিমরান বিনতে কামাল। আমি টিউশন থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। উনাকে এভাবে দেখে ভাবলাম, কোনো সমস্যা হয়েছে। তাই এগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু উনি হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বিশ্বাস করুন, আমি আর কিছু জানি না!”
ছেলেটি মাথা নাড়ল, যেন সিমরানের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। সে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“তুমি গাড়িটা এগিয়ে আনো। আমি অরণ্যকে নিয়ে যাচ্ছি।”
ড্রাইভার দ্রুত গাড়ির দিকে ছুটল। ছেলেটি এবার সিমরানের দিকে ফিরে বলল,
—“আপনিও আমাদের সঙ্গে আসুন।”
কথাটা শুনে সিমরানের মুখ শুকিয়ে গেল। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
—“কী বলছেন? আমি কোথায় যাব? আমি তো আপনাদের চিনি না!
__” কিন্তু ম্যাডাম…
ছেলেটির পুরো কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে সিমরান অস্থির হয়ে বলে উঠল,
__’ রাত হয়ে গেছে। আমার বাসায় ফিরতে হবে।
আমাকে যেতে দিন। সে অরন্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,প্লিজ আমাকে ছাড়ুন!”
সিমরান ছাড়ুন শব্দটা উচ্চারণ করতে অরণ্য তার হাতের মুষ্টি আরও শক্ত করল। সিমরান ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল, বলল,
—“প্লিজ, ছাড়ুন! ব্যথা লাগছে!”
ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল,
—“দেখুন, মিস সিমরান, আমি বুঝতে পারছি, বিষয়টা আপনার জন্য অস্বস্তিকর। কিন্তু আপনার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। এই মুহূর্তে অরণ্যকে সামলানো দরকার। আপনি এখন চলে গেলে, ও আরও অস্থির হয়ে উঠবে। প্লিজ, আমাদের সাহায্য করুন।”
সিমরানের মনে হাজারো প্রশ্ন। এই ছেলেটি কে? কেন এমন করছে? আর সে কেন এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল? কিন্তু অরণ্যের কাঁপতে থাকা হাত আর তার চোখের আতঙ্ক দেখে তার মনের ভেতরটা কিছুটা গলে গেল। সে দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
—“ঠিক আছে… কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আমার বাসায় ফিরতে হবে। আমার বাবা চিন্তা করবেন।”
ছেলেটি আশ্বাস দিয়ে বলল,
—“না, না বেশিক্ষন থাকতে হবে না। আমরা বাসায় ফিরেই ডাক্তারকে খবর দেব। অরণ্য একটু শান্ত হলেই আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে। আমি কথা দিচ্ছি।”
সিমরান একরাশ দ্বিধা আর অস্বস্তি নিয়ে রাজি হল। গাড়িতে ওঠার সময় অরণ্য তাকে ছাড়ল, কিন্তু তার পাশেই বসল। সিমরান জানালার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মনের ভেতর ঝড় বইছে। অরণ্যের উপস্থিতি তাকে অস্বস্তিতে ফেলছিল, কিন্তু তার চোখের ভয় তাকে কেন জানি আটকে রাখছিল।
দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামল এক বিশাল প্রাসাদের সামনে। সিমরান জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকল—চোখে বিস্ময়ের ছাপ, মুখে থমকে যাওয়া নিশ্বাস। যেন রূপকথার কোনো রাজপ্রাসাদ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে চোখ কচলাল, নিশ্চিত হওয়ার জন্য, *স্বপ্ন দেখছে না তো?*
অরণ্য গাড়ির দরজা খুলে ইশারায় নামতে বলল। তার মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখ দুটো বরাবরের মতোই স্থির—তবে এবার যেন তাতে আরও গভীরতা, আরও অদ্ভুত এক দাবি লুকিয়ে আছে। পুরো পথ ধরে সে একটাও কথা বলেনি, শুধু সিমরানের দিকে তাকিয়ে ছিল, এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন চোখ দিয়ে তার মনের গভীরে কিছু পড়তে চাইছে।
ভেতরে ঢুকতেই চোখ ধাঁধানো রাজকীয়তা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ঝাড়বাতির আলোয় মখমলের পর্দা, ভারী কারুকার্য খচিত ফার্নিচার—সব দেখে এক নিমেষে সিমরানের নিজেকে ক্ষুদ্র, অচেনা, অথচ বন্দি বলে মনে হল।সিমরান চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল তখন
একটি নম্র কণ্ঠ ভেসে এল,
—“বসুন, পানি খান।”
অরণ্যের পাশে বসা ছেলেটি একটি গ্লাস এগিয়ে দিল। মৃদু হাসি নিয়ে সে বলল,
—“আমি শুভ, অরণ্যের বন্ধু। আর এই হল অরণ্য চৌধুরী—স্কাইলাইন কর্পোরেশনের একমাত্র উত্তরাধিকারী, শহরের সবচেয়ে তরুণ শিল্পপতি।”
কথাটা শুনে সিমরানের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ল। সে ভাবতেই পারেনি, শহরের প্রথম সারির একজন শিল্পপতির সাথে তার এভাবে দেখা হয়েছে আর সে এখন তারই বাসায় বসে আছে। শুভ আবার বলল,
—“অরণ্যের এমন অবস্থা… মাঝেমধ্যে হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে। কিন্তু সে আজ আপনার সাথে এমন আচরণ করল কেন, আমি বুঝতে পারছি না।”
সিমরান কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল,
—“উনি তো এখন মোটামুটি সুস্থ আছেন। আমি তাহলে এখন যাই?”
সিমরানের কথা শেষ হওয়ার আগেই অরণ্য মাথা তুলল। তার চোখে শিকারীর মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সে ধীর, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—“তুমি কোথাও যাবে না।
শুভ চমকে তাকাল।
—“কী বলছিস, অরণ্য? তুই ঠিক আছিস?”
—“আমি একদম ঠিক আছি শুভ,কিন্তু ওকে যেতে দিবি না।”
শুভ ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“যেতে দেব না মানে? ওনাকে তো বাসায় যেতে হবে!”
অরণ্য এখনো সিমরানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ভয়ের পরিবর্তে এখন এক অদ্ভুত তীব্রতা ফুটে উঠছে। সে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
—“না, ও বাসায় যাবে না। ও আমার কাছে থাকবে।
-” কিসব উল্টা পাল্টা বলছিস?
—“ঠিকি বলছি ও আমার সব ভয়, সব অন্ধকার… থামিয়ে দিয়েছে। ও এখন থেকে শুধু আমার!”
সিমরান উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপা গলায় বলল,
—“আমি কিছু বুঝতে পারছি না! আমি আপনাদের কাউকে চিনি না! আমি শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। প্লিজ, আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। আমাকে যেতে দিন!”
শুভ তার সামনে এসে দাঁড়াল, শান্ত গলায় বলল,
—“চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।”
কিন্তু শুভের কথা শেষ হওয়ার আগেই অরণ্য উঠে এক পা এগিয়ে এল। তার চোখে অদ্ভুত এক স্থিরতা। সে বলল,
—“তুমি আমার ভয়ের আশ্রয়। তুমি আমার সব ভয়কে থামিয়ে দিয়েছ। তুমি চলে গেলে… আমি আবার সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাব। আমাকে ছেড়ে যেও না!”
সিমরান কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। তার চোখে স্পষ্ট ভয়। সে ফিসফিস করে বলল,
—“প্লিজ… আমাকে যেতে দিন। আমি এখানে থাকতে চাই না!”
সিমরানের হৃৎপিণ্ড যেন থেমে যাচ্ছে। শুভ দ্রুত বলল,
—“অরণ্য, শান্ত হ। তুই এভাবে বললে উনি ভয় পাবেন!”
শুভ সিমরানের দিকে ফিরে বলল,
—“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে বুঝাচ্ছি।”
কিন্তু অরণ্যের দৃষ্টি সিমরানের ওপর থেকে সরছে না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,
—“তুমি কোথাও যাবে না। তুমি আমার কাছে থাকবে। আমি তোমাকে হারাতে দেব না!”
সিমরান পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেল। তার হাত কাঁপছে। শুভ তাড়াতাড়ি অরণ্যের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—“অরণ্য, তুই এখন রেস্ট নে। আমি সিমরানকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।”
অরণ্যের মুখে একটা অন্ধকার হাসি ফুটে উঠল।
—“শুভ, আমি বললাম না, ও কোথাও যাবে না। ও এখানে থাকবে, আমার সঙ্গে। এখন থেকে ও শুধু আমার!”
সিমরানের পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। ঠিক তখনই বাড়িতে ডাক্তার এলেন। অরণ্যকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হল। অরণ্য ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল। সিমরান আর দেরি করল না। সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়ল।
শুভ তাকে নিজের গাড়িতে করে বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। পুরো পথে সিমরান চুপচাপ ছিল। তার মাথায় শুধু অরণ্যের অস্থির চোখ আর তার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল—
—“তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, তাই না?”
সিমরানের মনে একটা অদ্ভুত ভারী অনুভূতি জন্মাল। সে বুঝতে পারছিল, অরণ্যের জীবনে কোনো গভীর ক্ষত আছে। কিন্তু সে এই ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তার নিজের জীবনই যথেষ্ট জটিল।
বাসায় ফিরে সিমরান গরম পানিতে গোসল করল, এক কাপ চা নিয়ে বসল। তার মনে হচ্ছিল, এই রাতটা যেন একটা অদ্ভুত স্বপ্ন ছিল। সে নিজেকে বোঝাল, এটা শুধু একটা কাকতালীয় ঘটনা। অরণ্য চৌধুরীর মতো একজন ধনী, প্রভাবশালী মানুষ তার মতো সাধারণ মেয়েকে কেন নিজের কাছে রাখতে চাইবে?
সিমরান সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু সেই রাতের অদ্ভুত ঘটনা অরণ্যের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলল। পরদিন সকালে চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে ভেসে উঠল সিমরানের মুখ—সেই কণ্ঠ, সেই ভয়ে কেঁপে ওঠা চোখজোড়া। সব যেন তাকে এক অজানা বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছে। সে গম্ভীর গলায় বলল,
—“শুভ, মেয়েটার সম্পর্কে কিছু জানিস?”
শুভ চমকে গেল। তার ধারণা ছিল, অরণ্যের এই ঘটনার কথা মনে থাকবে না তাই সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল,
—“মানে?”
—“কী যেন নাম বলেছিল? ওহ হ্যাঁ, সিমরান! সিমরানের কথা বলছি। কোথায় থাকে, কী করে, কে ও?”
শুভ সতর্কভাবে বলল,
—“অরণ্য,উনি একটা সাধারণ মেয়ে। তোর মতো মানুষের জগতে তার কোনো লেনাদেন নেই। তুই উনার ব্যাপারে জানতে চাইছিস কেন?”
অরণ্য তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
—“আমি জানতে চাইছি,” তুই আমাকে উত্তর দে। বাড়তি কথা কেন বলছিস?”
শুভ একটু ভয় পেয়ে বলল,
—“আমি উনাকে বাসার কাছে গলিতে নামিয়ে দিয়েছিলাম। বাসা পর্যন্ত যাইনি। তাই বাসা কোনটা, জানি না।”
অরণ্য চুপ করে রইল। তার মনে সিমরানের উপস্থিতি যেন এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলেছিল। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—“ওকে খুঁজে বের কর। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
শুভ ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
—“অরণ্য, তুই কী ভাবছিস, আমি জানি না। কিন্তু মেয়েটা সাধারণ জীবনযাপন করে। আমার মনে হয় না, এটা করা ঠিক হবে।”
অরণ্যের চোখে জেদ চিকচিক করে উঠল।
—“আমি শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই আর তুই ওকে খুঁজে বের করবি আমার কথা বুঝতে পেরেছিস?”
শুভ কিছু না বলে মাথা নাড়ল। দুদিনের মধ্যেই অরণ্যের লোকেরা সিমরানের ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। অরণ্যের নির্দেশে তার একজন বিশ্বস্ত লোক সিমরানের বাসায় গেল।
সিমরান তখন বাসায় বসে পড়ছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সে দরজা খুলে দেখল, একজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি নিজেকে অরণ্যের পিএ পরিচয় দিয়ে বলল,
—“ম্যাডাম, অরণ্য স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি আপনাকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমার সঙ্গে চলুন।”
সিমরানের মুখ শুকিয়ে গেল। সে শান্ত, কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল,
—“আমি দুঃখিত, আমি যেতে পারব না। আমি আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। দয়া করে স্যারকে বলবেন, আমি তার সুস্থতার জন্য শুভকামনা জানিয়েছি, কিন্তু আমি যেতে পারব না।”
লোকটি একটু থমকে গেল। কারন অরণ্যের প্রস্তাব কাইকে ফিরিয়ে দিতে সে কখনো দেখেনি। তবে সে জোর করে সিমরানকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই পকেট থেকে একটা কালো-সোনালি কার্ড বের করে সিমরানের হাতে দিল। কার্ডে লেখা—‘অরণ্য চৌধুরী’, তার কোম্পানির লোগো, আর একটি ফোন নম্বর।
লোকটি শান্ত গলায় বলল,
—“স্যার বলেছেন, আপনার যদি কখনো কোনো দরকার পড়ে, এই নম্বরে যেন যোগাযোগ করেন। তিনি সবসময় আপনার পাশে থাকবেন।”
সিমরান কার্ডটি হাতে নিয়ে তাকাল। তার মনে হলো, এই ছোট্ট কার্ডটি যেন একটা অদৃশ্য শেকল, যা তাকে অরণ্যের জগতে টেনে নিতে চাইছে। সে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ল।
লোকটি চলে গেলে সিমরান দরজা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু তার মনের গভীরে একটা অস্থিরতা জেগে উঠল। তার মনে হচ্ছে এত সহজে এই অধ্যায় শেষ হবে না।
দরজা বন্ধ করে সিমরান কাঁপা হাতে কার্ডটি টেবিলের ওপর রাখল। তার ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করে উঠল। মন বলে উঠল কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত, কিন্তু তার হৃৎপিণ্ডের গভীরে একটা অজানা ভয়, বা হয়তো কোনো একটা অদ্ভুত কৌতূহল, তাকে আটকে রাখল। সে কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন এই ছোট্ট কাগজের টুকরোটাই তার জীবনের সমস্ত দিক পালটে দিতে চাইছে। সিমরানের হাত কাঁপছে, বুকের ভেতর একটা অস্থির ঝড় উঠেছে। কার্ডের সোনালি অক্ষরগুলো আলোর প্রতিফলনে ঝিকমিক করে যেন তাকে ডেকে বলছে, “তুমি পালাতে পারবে না।”
অন্যদিকে, অরণ্য চৌধুরী বাসার অফিসরুমে, বিশাল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। শহরের ঝিকিমিকি আলো তার মুখে এসে পড়ছে, তার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঠোঁটে ফুটে উঠেছে এক রহস্যময় হাসি, যেন সে কোনো গোপন পরিকল্পনার জাল বুনছে। ঘরের অন্যপ্রান্তে, সোফায় বসে তার বন্ধু শুভ তাকে লক্ষ করছে। অরণ্যের এই অস্বাভাবিক ভাবভঙ্গি শুভর মনে এক অজানা আশঙ্কার জন্ম দিল। সে এগিয়ে এসে অরণ্যের পাশে দাঁড়াল। শুভর কণ্ঠে উৎকণ্ঠার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল,
__“অরণ্য, তুই ঠিক আছিস তো?চেনা নেই-জানা নেই, এমন একটা মেয়ের জন্য তুই এতটা অস্থির হয়ে উঠছিস কেন?এর আগে তোকে কখনো এমন পাগলামি করতে দেখিনি!”
অরণ্য ধীরে ধীরে গ্লাসটা টেবিলে রাখল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক শীতল, রহস্যময় হাসি, যেন সে কোনো গভীর গোপনীয়তার মালিক। __“আমি নিজেও জানি না, আমার কী হয়েছে,শুধু এটুকু জানি, ওই মেয়েটার চোখে এমন কিছু ছিল… যা আমার ভেতরের সমস্ত অস্থিরতাকে এক পলকে শান্ত করে দিয়েছে। তার দৃষ্টিতে যেন একটা অজানা শান্তি লুকিয়ে আছে, যা আমার অন্ধকার মনকে আলো দিয়েছে। তাই ওকে আমার চাই। ও যদি আমার কাছে থাকে, আমার ভালো লাগবে…আমি পূর্ণতা অনুভব করব।”
শুভর মুখে চিন্তার ছায়া আরও গভীর হলো। তার কণ্ঠে উদ্বেগের সুর আরও তীব্র হয়ে উঠল। __“দেখ, অরণ্য, এটা কোনো জড় বস্তু নয় যে তুই যেভাবে খুশি এনে নিজের কাছে রেখে দিবি। এটা একটা মানুষের জীবন, তার নিজস্ব ইচ্ছা,অনিচ্ছা আছে! তাছাড়া, মেয়েটা স্পষ্ট বলেছে, সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তুই কেন জোর করে তার জীবনে ঢুকতে চাইছিস? এটা কি ঠিক?”
অরণ্য হাসল, তার চোখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক খেলে গেল। সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
__“জোর? না, শুভ। আমি জোর করছি না। আমি ওকে এমনভাবে আমার কাছে টেনে আনব, যাতে ও নিজেই আমার কাছে ছুটে আসে। তার মন, তার ইচ্ছা—সবকিছু আমার হবে, আর এ সব কিছুই হবে তার নিজের সিদ্ধান্তে।”
শুভ অবাক হয়ে তাকাল, তার চোখে বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা মিশে গেল।
__“মানে? তুই কী করতে চাইছিস, অরণ্য?
অরণ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, তার কণ্ঠে এক শীতল নিশ্চয়তা।
__“সময় হলেই জানতে পারবি।”
তার কথায় মিশে গেল এক অমোঘ আত্মবিশ্বাস, যেন সে ইতিমধ্যেই তার পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ নিখুঁতভাবে সাজিয়ে ফেলেছে। তার চোখে জ্বলছে এক অদম্য দৃঢ়তা, যা শুভকে আরও অস্থির করে তুলল।
শুভ আর কিছু বলল না। কিন্তু তার মনের ভেতর একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধল। সে জানে অরণ্য যখন কোনো কিছুর পিছনে পড়ে, তাকে থামানো অসম্ভব। সে বুঝতে পারল—অরণ্যের এই অন্ধকার আকাঙ্ক্ষা একটা ভয়ঙ্কর ঝড় ডেকে আনতে চলেছে, যার কেন্দ্রে আছে এক নিরীহ মেয়ের জীবন।
ইতিমধ্যে অরণ্যের লোকজন সিমরানের প্রতিটি তথ্য জোগাড় করতে শুরু করেছে—তার কলেজের সময়সূচি, টিউশন, বন্ধুবান্ধব, আর্থিক অবস্থা—সব। অরণ্য জানে, সিমরান একটি সাধারণ ঘরের মেয়ে, তাকে তার জগতে টেনে আনতে হলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেখানে তার আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই সে সিমরানের পিছনে কয়েকজনকে নিয়োগ করেছে, যারা চব্বিশ ঘণ্টা সিমরানের ওপর নজর রাখে এবং সিমরানের প্রতিটি পদক্ষেপের বর্ননা অরণ্যের কাছে পৌঁছে দেয়।
অন্যদিকে, সিমরান সেই রাতের ঘটনা ভুলে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে