“ভাইয়া, ছাড়ুন! প্লিজ, আমার ব্যথা লাগছে! কী করছেন আপনি?”
সিমরানের কণ্ঠ আর্তনাদে ভেঙে পড়ে। তার কবজি অরণ্যের লোহার মতো শক্ত মুঠোয় বন্দী, প্রতিটি টানে তার হাতে যন্ত্রণার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার কান্নাভেজা আকুতি অরণ্যের হৃদয়হীন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসল। হাসপাতালের নির্জন করিডোর থেকে তাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল অরণ্য। গাড়ির দরজা খুলে সিমরানকে ভেতরে ছুড়ে ফেলল সে, যেন সে কোনো প্রাণহীন জড় বস্তু।
সিমরানের চোখে জল টলটল করছে, তার কণ্ঠ ভেঙে আসছে, কিন্তু অরণ্যের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। সে দ্রুত ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে, ইঞ্জিন চালু করল। গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন যেন তার রাগেরই প্রতিনিধিত্ব করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামে অরণ্যের বিশাল বাড়ির সামনে। প্রাসাদোপম এই বাড়ির উঁচু দেয়াল আর লোহার গেট সিমরানের জন্য এক অদৃশ্য কারাগার। অরণ্য আবারও তাকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির লোকজন, চাকর-বাকররা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। অরণ্য ঘরে ঢুকতেই তার কণ্ঠে আগুন ঝরে পড়ে।
__”এত টাকা দিয়ে আমি গার্ড কেন রেখেছি?” তার চিৎকারে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। __”এতগুলো লোক মিলে একটা মেয়েকে সামলাতে পারো না? আমি কী বলেছিলাম? সিমরান যেন বাড়ির বাইরে এক পা-ও না রাখে! আমার কথা কি কারও কানে যায়নি? তবু সে কীভাবে বাড়ির বাইরে গেল?”
তার কথার তীব্রতায় ঘরের সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ কালো পোশাক পরা একজন গার্ড ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে।আর কাঁপা কন্ঠে বলে __”স্যার, সরি… ম্যাডাম বলেছিলেন, তিনি তার বাবার সাথে দেখা করতে হাসপাতালে যাচ্ছেন। তাই আমরা কেউ বাধা দিইনি।”
কথাটা শুনেই অরণ্যের রাগ আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হল। সামনের টেবিলে রাখা কাচের ফুলদানিটা হাতে তুলে সে মেঝেতে ছুড়ে মারে। ফুলদানি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, প্রতিটি টুকরো যেন তার অসংযত ক্রোধের সাক্ষী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ।
__”ম্যাডাম তোমাদের এই বাড়িতে কাজে রাখেনি!এই বাড়িতে আমার কথায় শেষ কথা আমি বলেছি ওর বাড়ির বাইরে যাবে না মানে ও যাবেনা।আমার আদেশ অমান্য করলে পরের বার কী হবে, আশা করি আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।”
তার কথার মাঝেই সিমরানের কণ্ঠ ভেসে আসে,
__”আপনি আমার সাথে এমন করতে পারেন না! আমি কোনো খেলনা নই যে আপনার ইচ্ছেমতো আমাকে নিয়ে খেলবেন!”
কথাটা বলতে না বলতেই অরণ্যের হাত উঠে যায়। সবার সামনে একটা কর্কশ থাপ্পড় পড়ে সিমরানের গালে। ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সিমরান অবাক চোখে তাকায় অরণ্যের দিকে, তার চোখে অবিশ্বাস আর কষ্টের মিশ্রণ।
__”আপনি… আমাকে মারলেন?এত সাহস আপনাকে কে দিয়েছে?”
অরণ্যের চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। সে ঠান্ডা গলায় বলে,
__”চুপ! একদম চুপ! আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি সিমরান—উচ্চস্বরে কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আর সাহস? হ্যাঁ, আমার সাহস আছে, তাই গায়ে হাত তুলেছি। এরপর আমার কথা অমান্য করলে তার শাস্তি এর চেয়েও ভয়ানক হবে।”
সিমরানের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সে বলে উঠে,
__”ভুলে যাবেন না, এই দেশে এখনও আইন-কানুন আছে।আপনার যা ইচ্ছা আপনি করতে পারেন না”
অরণ্য হাসে, তার হাসিতে এক প্রকার বিদ্রূপ ফুটে উঠে।
__”বেশ, যা! পুলিশের কাছে যা! কে মানা করেছে? কিন্তু তারপর কী হবে, তুই ভালো করেই জানিস। আমার টাকায় তোর বাবার চিকিৎসা চলছে। আমি চাইলেই সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। আশা করছি ভুলে যাস নি?”
অরণ্যের কথায় সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বলে,
__”আমি… আমি খালামণিকে সব বলে দেব। আপনি কীভাবে আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন, সব বলব!”
অরণ্যের ঠোঁটে আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে “আগে তো খালামণির দেখা পা, তারপর বলিস। এখন চুপচাপ নিজের ঘরে যা। আর কখনো আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখবি না। কথাটা যেন মাথায় থাকে।”
সিমরান আর কথা বাড়ায় না। নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দরজা বন্ধ করে সে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েক দিনে তার জীবন পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে। এই অরণ্য তার খালাতো ভাই, কিন্তু মাত্র কয়েক দিন আগেও সে তাকে চিনত না। হঠাৎ ঝড়ের মতো অরণ্য তার জীবনে এসেছে, তার সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। সিমরানের মনে পড়ে যায় সাত দিন আগের সেই ভয়ঙ্কর দিন, যেদিন থেকে তার জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায় শুরু হয়েছে।