Mdigitech

Opurno Prem Part 3 Bangla Golpo

দরজা বন্ধ করার পর সিমরান কাঁপা হাতে কার্ডটি টেবিলের ওপর রাখল। তার ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করে উঠল। মন বলে উঠল কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত, কিন্তু তার হৃৎপিণ্ডের গভীরে একটা অজানা ভয়, বা হয়তো কোনো একটা অদ্ভুত কৌতূহল, তাকে আটকে রাখল। সে কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন এই ছোট্ট কাগজের টুকরোটাই তার জীবনের সমস্ত দিক পালটে দিতে চাইছে। সিমরানের হাত কাঁপছে, বুকের ভেতর একটা অস্থির ঝড় উঠেছে। কার্ডের সোনালি অক্ষরগুলো আলোর প্রতিফলনে ঝিকমিক করে যেন তাকে ডেকে বলছে, “তুমি পালাতে পারবে না।”
অন্যদিকে, অরণ্য চৌধুরী বাসার অফিসরুমে, বিশাল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। শহরের ঝিকিমিকি আলো তার মুখে এসে পড়ছে, তার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঠোঁটে ফুটে উঠেছে এক রহস্যময় হাসি, যেন সে কোনো গোপন পরিকল্পনার জাল বুনছে। ঘরের অন্যপ্রান্তে, সোফায় বসে তার বন্ধু শুভ তাকে লক্ষ করছে। অরণ্যের এই অস্বাভাবিক ভাবভঙ্গি শুভর মনে এক অজানা আশঙ্কার জন্ম দিল। সে এগিয়ে এসে অরণ্যের পাশে দাঁড়াল। শুভর কণ্ঠে উৎকণ্ঠার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল,
__“অরণ্য, তুই ঠিক আছিস তো?চেনা নেই-জানা নেই, এমন একটা মেয়ের জন্য তুই এতটা অস্থির হয়ে উঠছিস কেন?এর আগে তোকে কখনো এমন পাগলামি করতে দেখিনি!”
অরণ্য ধীরে ধীরে গ্লাসটা টেবিলে রাখল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক শীতল, রহস্যময় হাসি, যেন সে কোনো গভীর গোপনীয়তার মালিক। __“আমি নিজেও জানি না, আমার কী হয়েছে,শুধু এটুকু জানি, ওই মেয়েটার চোখে এমন কিছু ছিল… যা আমার ভেতরের সমস্ত অস্থিরতাকে এক পলকে শান্ত করে দিয়েছে। তার দৃষ্টিতে যেন একটা অজানা শান্তি লুকিয়ে আছে, যা আমার অন্ধকার মনকে আলো দিয়েছে। তাই ওকে আমার চাই। ও যদি আমার কাছে থাকে, আমার ভালো লাগবে…আমি পূর্ণতা অনুভব করব।”
শুভর মুখে চিন্তার ছায়া আরও গভীর হলো। তার কণ্ঠে উদ্বেগের সুর আরও তীব্র হয়ে উঠল। __“দেখ, অরণ্য, এটা কোনো বস্তু নয় যে তুই যেভাবে খুশি এনে নিজের কাছে রেখে দিবি। এটা একটা মানুষের জীবন, তার নিজস্ব ইচ্ছা,অনিচ্ছা আছে! তাছাড়া, মেয়েটা স্পষ্ট বলেছে, সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তুই কেন জোর করে তার জীবনে ঢুকতে চাইছিস? এটা কি ঠিক?”
অরণ্য হাসল, তার চোখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক খেলে গেল। সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
__“জোর? না, শুভ। আমি জোর করছি না। আমি ওকে এমনভাবে আমার কাছে টেনে আনব, যাতে ও নিজেই আমার কাছে ছুটে আসে। তার মন, তার ইচ্ছা—সবকিছু আমার হবে, কিন্তু সব হবে তার নিজের সিদ্ধান্তে।”
শুভ অবাক হয়ে তাকাল, তার চোখে বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা মিশে গেল।
__“মানে? তুই কী করতে চাইছিস, অরণ্য?
অরণ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, তার কণ্ঠে এক শীতল নিশ্চয়তা।
__“সময় হলেই জানতে পারবি।”
তার কথায় মিশে গেল এক অমোঘ আত্মবিশ্বাস, যেন সে ইতিমধ্যেই তার পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ নিখুঁতভাবে সাজিয়ে ফেলেছে। তার চোখে জ্বলছে এক অদম্য দৃঢ়তা, যা শুভকে আরও অস্থির করে তুলল।
শুভ আর কিছু বলল না। কিন্তু তার মনের ভেতর একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধল। সে জানে অরণ্য যখন কোনো কিছুর পিছনে পড়ে, তাকে থামানো অসম্ভব। সে বুঝতে পারল—অরণ্যের এই অন্ধকার আকাঙ্ক্ষা একটা ভয়ঙ্কর ঝড় ডেকে আনতে চলেছে, যার কেন্দ্রে আছে এক নিরীহ মেয়ের জীবন।
ইতিমধ্যে অরণ্যের লোকজন সিমরানের প্রতিটি তথ্য জোগাড় করতে শুরু করেছে—তার কলেজের সময়সূচি, টিউশন, বন্ধুবান্ধব, আর্থিক অবস্থা—সব। অরণ্য জানে, সিমরান একটি সাধারণ ঘরের মেয়ে, তাকে তার জগতে টেনে আনতে হলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেখানে তার আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই সে সিমরানের পিছনে কয়েকজনকে নিয়োগ করেছে, যারা চব্বিশ ঘণ্টা সিমরানের ওপর নজর রাখে এবং সিমরানের প্রতিটি পদক্ষেপের বর্ননা অরণ্যের কাছে পৌঁছে দেয়।
অন্যদিকে, সিমরান সেই রাতের ঘটনা ভুলে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছিল—কলেজে যাওয়া, টিউশন পড়ানো, বাবার সঙ্গে ছোট ছোট মুহূর্তে হাসি ভাগ করে নেওয়া, এভাবেই তার সময় কাটছিল। কিন্তু রাতের নির্জন রাস্তায় হাঁটার সময়, বা কলেজের ভিড়ে, মাঝে মাঝে সিমরানের মনে হতো কেউ তাকে লক্ষ করছে। কিন্তু সে এই অনুভূতিকে উড়িয়ে দিয়েছিল, ভেবেছিল এটা শুধুই তার মনের ভ্রম। কিন্তু সে জানত না, তার চারপাশে একটি অদৃশ্য জাল ছড়িয়ে পড়ছে। যার প্রতিটি সুতো অরণ্যের হাতে নিখুঁত নকশা করা।
কিছুদিনের মধ্যেই সেই জালে বুনা অন্ধকার নেমে এল সিমরানের জীবনে । সিমরানের বাবা, অনেকদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন, এক সকালে হঠাৎ মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বাবার অবস্থা দেখে সিমরানের হৃৎপিণ্ড যেন থমকে গেল।সে তাড়াহুড়ো করে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।  হাসপাতালের ঠান্ডা, জীবাণুমুক্ত করিডোরে দাঁড়িয়ে, ডাক্তারের গম্ভীর মুখ দেখে সিমরানের বুক কেঁপে উঠল।ডাক্তার ভারী কন্ঠে বললেন,
__“আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম মিস সিমরান, অপারেশন করতে হবে।এবার দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। এখনই অপারেশন করতে হবে, নইলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।”
সিমরান অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল,
__“অপারেশন করতে কত টাকা লাগবে?”
ডাক্তার একটু থেমে বললেন,
___“সব মিলিয়ে খরচ হতে পারে প্রায় ছয় লাখ টাকা।”
টাকার অঙ্ক শুনে সিমরানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার বাবা ছাড়া এই পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই। কিন্তু ছয় লাখ টাকা? এ যেন তার কাছে অমাবস্যার চাঁদ! হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ঠান্ডা দেয়ালে হেলান দিল সিমরান, তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল, তার বুকের ভেতর এক অসহায় যন্ত্রণা জেগে উঠল। যেভাবেই হোক, টাকা জোগাড় করতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবে সে এত টাকা? কীভাবে জোগাড় করবে?
🍁
সিমরানের জীবন যেন এক অন্ধকার গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছে, যেখানে প্রতিটি পথ শুধু হতাশা আর অসহায়ত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন টাকার জন্য ছুটোছুটি করে সে ক্লান্ত, শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই, তবু তার মন হাল ছাড়েনি। ব্যাংকের নির্লিপ্ত কাউন্টার থেকে শুরু করে পরিচিত আত্মীয় স্বজন সবার দ্বারস্থ হয়ে সে সাহায্যের জন্য মিনতি করেছে। এমনকি তার কাছে থাকা কয়েকটি পুরোনো গয়না—মায়ের শেষ স্মৃতি—তাও বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু ছয় লাখ টাকা? এই অঙ্ক তার কাছে এক অসম্ভব সংখ্যা। সে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ল কিন্তু হাসপাতালে বাবার কষ্টে কাতর মুখটি মনে পড়তেই তার বুক ফেটে কান্না পেল,সে থামল না।
🍁
দিন শেষে, টিউশন শেষ করে রাতের গাঢ় অন্ধকারে বাসার দিকে হাঁটছিল সিমরান। নির্জন রাস্তায় আলো আঁধারের মিশেল, দূরে কয়েকটি কুকুরের ডাক ভেসে আসছে,তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটি যেন পুরো পৃথিবীর ভার বহন করে চলেছে—তার বাবার জীবন, তার নিজের অসহায়ত্ব, আর এক অজানা ভয়। সিমরান ধীর পায়ে হাঁটছে, তার মাথা নিচু, চোখে হতাশার ছায়া। হঠাৎ, পেছন থেকে একটি গাড়ির ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জন ভেসে এল। শব্দটি রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। সিমরান পিছনে তাকানোর আগেই ছায়ার মতো কয়েকটি কালো পোশাক পরা লোক তার দিকে ছুটে এল। তাদের মুখ ঢাকা ছিল, চোখে কঠিন দৃষ্টি।
__“কে আপনারা? আমাকে ছাড়ুন! প্লিজ!” সিমরান চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কণ্ঠ কাঁপছিল, ভয়ে দমে যাচ্ছিল। একজন তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরল, আরেকজন দ্রুত তার চোখে একটি কালো কাপড় বেঁধে দিল। অন্ধকার তার দৃষ্টিকে গ্রাস করল। সিমরান ছটফট করছিল, তার হাত-পা আঁকড়ে ধরে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু লোকগুলোর শক্তির সাথে পেরে উঠল না। তারা তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে দিল। তার বুকের ভেতর ভয়ে হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে যাচ্ছিল। কারা এরা? কেন আমাকে ধরছে? তার মন প্রশ্নে ভরে গেল, কিন্তু উত্তর পেল না। ঠিক তখনই গাড়ির ভিতরে একজন আলতো হাতে সিমরানকে নিজের কাছে টেনে নিল। সিমরানের ছটফটকে থামিয়ে ফিয়ে সিমরানকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ গোঁজে দিল। সিমরানের মেরুদন্ডে হিম স্রোত বয়ে গেল। তার মনে হল তার কপালে কারোর ঠোঁট ছুঁয়েছে সিমরান পুরোপুরি বুঝার আগেই নাকে একটি তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধ এল,আর সবকিছু অন্ধকারে ডুবে গেল।
🍁
বেশ অনেক্ষন পর সিমরানের জ্ঞান ফিরল। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যেমন লাগে, সিমরান চোখ খুলে অবাক হল, চারপাশে মৃদু আলোর ঝাপসা অন্ধকার চোখে পড়ছে। সে বুঝতে পারল, সে একটি বিশাল বিছানায় শুয়ে আছে। বিছানার চাদর মসৃণ, সিল্কের মতো নরম, আর বাতাসে সুগন্ধ ভেসে আসছে।
সিমরান উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাত-পা দুর্বল লাগছে, যেন কেউ তার সমস্ত শক্তি চুষে নিয়েছে। তার মাথা ঘুরছে, বুকের ভেতর ভয় আর বিভ্রান্তি একসঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে।
__ আমি কোথায়? কারা আমাকে এখানে এনেছে? কেন?ওই লোকটি কে ছিল যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল? তার মন প্রশ্নের ঝড়ে ভরে গেল, কিন্তু কোনো উত্তর মিলল না।
সিমরান বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে চাইলো ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল দেয়ালে ঝোলানো একটি বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবির দিকে। ছবিতে একজন পুরুষ—দামি স্যুটে সজ্জিত, চোখে তীক্ষ্ণ শিকারীর দৃষ্টি, ঠোঁটে একটি হালকা, রহস্যময় হাসি। সিমরানের শ্বাস আটকে গেল। অরণ্য চৌধুরী!
তার মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেই রাতের স্মৃতি ফিরে এল—অরণ্যের অস্থির, তীব্র চোখ, তার শক্ত মুঠির আঁকড়ে ধরা, আর তার ফিসফিসে কণ্ঠে বলা কথা: “তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, তাই না?” সিমরানের হাত কাঁপতে শুরু করল। তার বুকের ভেতর ভয় আর বিস্ময়ের ঝড় বয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এই অন্ধকার ঘর, এই রাজকীয়তা—সবই অরণ্যের। কিন্তু কেন? কেন সে তাকে এভাবে তুলে এনেছে? তার মনের ভেতর এক অজানা আশঙ্কা জেগে উঠল, যেন সে একটি অন্ধকার জালের মধ্যে আটকা পড়েছে, যার প্রতিটি সুতো তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।……

1 thought on “Opurno Prem Part 3 Bangla Golpo”

  1. Pingback: Opurno Prem Part 4 | Golpo Bangla - Mdigitech

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top