সিমরানের হাত থেমে গেল। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু সে দ্রুত হাতে তা মুছে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে শার্টের পরের বোতাম লাগানোর চেষ্টা করল, তার আঙুল এখনো কাঁপছে। অরণ্যের শরীরের উষ্ণতা, তার দৃষ্টির তীব্রতা তাকে যেন শ্বাসরোধ করে দিতে চাইছে। সে মনে মনে বলল, *“আমাকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। বাবার জন্য সব মেনে নিতে হবে। আমি মেনে নিব,আমি হারব না বাবা।”*
অবশেষে শার্টের শেষ বোতামটা লাগানো শেষ হল। সিমরান পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
সকালের নরম আলো ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। অরণ্য সিমরানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
__“সামান্য বোতাম লাগাতে এত দেরি করলে কিভাবে হবে? আমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে তো। টাইটা বেঁধে দে, সিমরান।”
অরণ্যের কণ্ঠে মখমলের মতো নরম সুর বাজছে, যেন সে শুধু আদেশ দিচ্ছে না, সিমরানের মনের দরজায় আলতো করে কড়া নাড়ছে। সিমরানের টাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
__“টাই? আমি… আমি কীভাবে?”
সিমরান যে লজ্জা পাচ্ছে অরণ্যের তা বুঝার বাকি নেই তবে অরণ্য যেন সিমরানের লজ্জাকে শুধু উপভোগ করছে না, তার আরও গভীরে পৌঁছে যেতে চাইছে
__“কীভাবে মানে? আমি চাই আমার প্রতিটি মুহূর্তে তোর ছোঁয়া মিশে থাকুক। তাই কথা না বাড়িয়ে, কাছে আয়।
সিমরানের মুখ লাল হয়ে উঠল। তার হাত কাঁপছে, যেন তার শরীর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। কিন্তু অরণ্যের দৃষ্টির মায়াবী টান তাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। সে টাইটা হাতে তুলে নিল, তার আঙুল কাঁপছে, যেন টাইয়ের হালকা কাপড় তার হৃৎপিণ্ডের ওজনের চেয়েও ভারী মনে হচ্ছে।
অরণ্য তার সামনে এগিয়ে এল, তার গায়ের হালকা, মিষ্টি গন্ধ সিমরানের চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সিমরানের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে শুরু করেছে। অরণ্যের এত কাছে আসায় তার শরীরে একটা অদ্ভুত মিশ্রণ জেগে উঠল—লজ্জা, ভয়, আর একটা অব্যক্ত আকর্ষণ। তার হাত কাঁপতে কাঁপতে টাইটা অরণ্যের গলায় জড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার আঙুল যেন স্থির থাকতে চাইছে না।
সিমরানের কাঁপা-কাঁপি দেখে অরণ্যের চোখে একটা দুষ্টু, মায়াবী হাসি ফুটে উঠল। সে সিমরানের কাঁপা হাতের দিকে তাকিয়ে, বলল,
__“কী ব্যাপার তুই এত কাঁপছিস কেন? লজ্জা পাচ্ছিস, নাকি ভয় পাচ্ছিস? নাকি আমার এত কাছে আসায় নিজের হৃৎপিণ্ডের নিয়ন্ত্রন হারিয়েছিস?
অরণ্যের কথায় সিমরান এক ঝটকায় দূরে সরে গিয়ে বলল,
__”আমি লজ্জা পাচ্ছি না! আসলে… আমি টাই বাঁধতে পারি না। আগে কখনো বাঁধিনি। আপনি নিজে নিজে বেঁধে নিন প্লিজ। ”
সিমরানের কথায় অরণ্যের ঠোঁটে একটা দুষ্টু, মোহনীয় হাসি ফুটে উঠল,যেন সে সিমরানের প্রতিটি কাঁপন, প্রতিটি লজ্জাকে গভীরভাবে উপভোগ করছে। সে সিমরানের দিকে ঝুঁকে বলল,
__“টাই বাঁধতে পারিস না? বেশ, চল, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।”
সিমরানের হৃৎপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার চোখে বিস্ময় আর অস্বস্তি মিশে গেল। সে কিছু বলার আগেই অরণ্য তার হাত ধরে ফেলল। তার শক্ত, উষ্ণ হাতের স্পর্শে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল। অরণ্য তাকে আলতো করে টেনে ঘরের কোণে রাখা বড় আয়নার সামনে নিয়ে গেল। আয়নার ঠান্ডা কাচের সামনে দাঁড়িয়ে সিমরানের শ্বাস ভারী হয়ে উঠল। অরণ্য তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে, তার শরীর সিমরানের সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। তার গরম নিঃশ্বাস সিমরানের ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে।
__“দেখ, এটা কঠিন কিছু নয়, সে সিমরানের হাত ধরে টাইটা তার গলায় জড়াল, তার আঙুল সিমরানের কাঁপা আঙুলের ওপর রেখে ধীরে ধীরে গিঁট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু করল। “প্রথমে এভাবে টাইটা ক্রস করবি… তারপর এটা এভাবে ওপরে তুলে নীচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিবি…”
তার কণ্ঠে ছিল একটা অদ্ভুত মায়া, যেন সে শুধু টাই বাঁধা শেখাচ্ছে না, সিমরানের মনের গভীরে একটা স্থান দখল করতে চাইছে। “কিরে বুঝতে পারছিস”
সিমরানের হাত এখনো কাঁপছে সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। তার আঙুল অরণ্যের আঙুলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আয়নায় তাদের প্রতিবিম্ব দেখে সিমরানের লজ্জা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। অরণ্যের শরীর তার এত কাছাকাছি, তার বুক সিমরানের পিঠে ঠেকছে, তার নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে একটা উষ্ণ ঢেউ তুলছে সিমরানের মুখ লাল হয়ে উঠল, তার চোখ আয়নায় অরণ্যের চোখের সঙ্গে মিলতেই সে দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে নিল। অরণ্য সিমরানের অনুভূতি বেশ বুঝতে পেরেছে সে হেসে উঠল, তার হাসিতে একটা মোহনীয় আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়ল। তার হাসিতে সিমরানের হাত আরও কাঁপতে শুরু করেছে, তার আঙুল টাইয়ের গিঁট বাঁধতে গিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছে। অরণ্য এবার সিমরানের হাত শক্ত করে ধরে তার আঙুল সিমরানের আঙুলের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে টাইয়ের গিঁট তৈরি করার চেষ্টা করল।
সিমরান তখন ফিসফিসিয়ে বলল,
__“আমি… আমি সত্যিই টাই বাঁধতে পারি না,”
অরণ্য সিমরানের আরও কাছে ঝুঁকে, তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
__“টাই বাঁধতে পারিস না, নাকি লজ্জা পাচ্ছিস?
__”আমি…আমি লজ্জা পাচ্ছি না
__” সত্যি?তাহলে তোর মুখ লাল হয়ে আছে কেন? তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝি না? তবে কি জানিস তোর এই লজ্জা, এই কাঁপন—আমার বেশ ভালো লাগে
অরণ্যের কথায় সিমরানের মুখ আরও লাল হয়ে গেল। আয়নায় তাদের প্রতিবিম্ব—অরণ্যের শক্ত, উষ্ণ শরীর তার পেছনে, তার হাত তার হাতের ওপর—তাকে যেন আরও নাজুক করে দিচ্ছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে টাইয়ের গিঁট বাঁধার চেষ্টা চালিয়ে গেল, অরণ্যের হাত তার হাতকে পথ দেখাচ্ছিল। অবশেষে গিঁটটা কোনোরকমে তৈরি হল, যদিও একটু আড়ষ্ট আর অগোছালো।
অরণ্য আয়নায় নিজেকে দেখল, তারপর সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
__”প্রথমবারের মত খারাপ হয়নি, কিন্তু সিমরান, পরের বার যেন পারফেক্ট হয়।
টাইয়ের গিঁট বাঁধা শেষ হতেই সিমরান এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল, যেন সে অরণ্যের উষ্ণ নৈকট্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়।। আয়নার কাচে তখনও স্পষ্ট তাদের জোড়া প্রতিচ্ছবি। সিমরানের বুকের ভেতর এখনো থরথর করছে, আঙুলের গাঁটে গাঁটে যেন রয়ে গেছে অরণ্যের স্পর্শের স্মৃতি। এই মুহূর্তে চারপাশ নিঃশব্দ, অথচ তার ভেতরটা কথায় কথায় ভরে আছে।
সে নিঃশব্দে, নিজের অন্তরাত্মার গভীরে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল
—“অরণ্য আসলে কী চায়?”
প্রশ্নটা ছুরির মতো ধারালো, অথচ উত্তরহীন। সে কি শুধুই সিমরানের শরীরের প্রতি আকৃষ্ট? যদি তাই হয়, তবে এত ধৈর্য, এত সংযমের কী প্রয়োজন? তার ক্ষমতা আছে, দম্ভও আছে—সে চাইলে জোর করে নিজের চাহিদা মেটাতে পারে।
কিন্তু সে তা করে না। বরং প্রতিবার সে ধীরে ধীরে কাছে আসে, মেপে মেপে স্পর্শ করে—এমনভাবে, যেন তার ছোঁয়া কোনো নিষিদ্ধ কামনা নয়, বরং এক অলক্ষ্য দাবি আছে যা অধিকারের মতো ফুটে ওঠে।
সিমরানের ভেতর এক গুমোট সংশয় জমে উঠল। তবে কি সে আমার শরীর নয়, আমার মন চায়? এই প্রশ্নের উত্তর সে জানে না, কিন্তু তার হৃদয় অনুভব করে—অরণ্যের আচরণে এক রহস্যময় গভীরতা আছে। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি স্পর্শ যেন শুধু কামনার নয়, বরং এক অদৃশ্য দখলের চেষ্টা। যেন সে সিমরানের মনের দুয়ার খুলতে চায়, ধীরে ধীরে, নরম গিঁটে গিঁটে, কিন্তু অটুট শক্তিতে।
সিমরান বুঝতে পারে না—এই চাহিদা কি ভালোবাসার, নাকি কেবল জয়ের তৃষ্ণা? তবু সে এটুকু নিশ্চিত—অরণ্য তার হৃদয়ের চারপাশে এক অদৃশ্য জাল বুনে চলেছে। প্রতিটি গিঁট নরম, সূক্ষ্মভাবে বোনা, অথচ ভয়ানক রকমের শক্ত। সে আয়নার দিকে তাকাল, যেখানে অরণ্যের প্রতিবিম্ব এখনো তার পাশে দাঁড়িয়ে, যেন তার নিঃশ্বাসে, তার দৃষ্টিতে সিমরানকে বেঁধে ফেলছে।