Mdigitech

Oronner Chaya Megh Part 8

**সতর্কতা**: গল্পের এই অংশে সংবেদনশীল বিষয়বস্তু রয়েছে, যার মধ্যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের উল্লেখ আছে। এটি গল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং পাঠকের অনুরোধ অনুযায়ী সংবেদনশীল ভাষায় লেখা হয়েছে।
পরদিন সকালে সূর্যের প্রথম আলো সিমরানের ঘরে জানালার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করল, কিন্তু সেই আলো তার মনের অন্ধকার ছুঁতে পারল না। বিছানায় শুয়ে থাকা সিমরানের শরীর যেন একটা ভাঙা পুতুলের মতো, নিথর, ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে। তার চোখ এখনও অশ্রুতে ভেজা, পাপড়িগুলো ভারী হয়ে আছে। রাতের কান্না তার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। তার মনে হচ্ছে, সে শুধু শরীরে বেঁচে আছে, আত্মা কোথাও হারিয়ে গেছে। অরণ্যের নিষ্ঠুর স্পর্শ, তার হিংস্র কথা, তার দৃষ্টির ওজন,পায়ের ব্যাথা—সবকিছু তার মনের ভেতর একটা কালো পর্দা টেনে দিয়েছে।
হঠাৎ দরজায় একটা মৃদু টোকার শব্দে সে চমকে উঠল। তার হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠল, একটা ঠান্ডা ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। মনে হল, অরণ্য আবার এসেছে। শরীর কুঁকড়ে গেল, হাত-পা শক্ত হয়ে এল। সে বিছানায় আরও গুটিয়ে গেল,যেন সে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু তার ভয় ভেঙে দিয়ে দরজার ওপার থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এল, নরম, কিন্তু দৃঢ়।
—“ম্যাডাম, ভেতরে আসব?”
সিমরান উত্তর দিল না। তার গলা শুকিয়ে গেছে, কথা বের হচ্ছে না। তার মন চিৎকার করে বলতে চাইল,
__“আমাকে একটু একা থাকতে দাও!” কিন্তু তার ঠোঁট নড়ল না। দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে নাজমা, এই বাড়ির কাজের মেয়ে। তার পরনে একটা সাধারণ সুতির শাড়ি, চোখে সরল, কর্তব্যপরায়ণ ভাব। তার হাতে একটা ট্রে, তাতে এক গ্লাস পানি। নাজমা সিমরানের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে একটু দ্বিধা করল, তারপর নরম কণ্ঠে বলল,
—“ম্যাডাম, ছোট সাহেব বলেছেন, তিনি ন’টায় অফিসে যাবেন। আপনি যেন তার আগে নাস্তা তৈরি করেন।”
সিমরানের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তার বুকের ভেতর একটা তীব্র ক্রোধ আর অপমানের ঝড় উঠল। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, নাস্তা তৈরি করতে হবে? তবে কি অরণ্য তাকে শুধু বন্দীই নয়, কাজের মেয়েও বানাতে চায়? তার মনে পড়ল অরণ্যের সেই নির্লজ্জ হাসি, তার কথাগুলো—“আমার চাহিদা মেটানোর জন্যই তোকে এনেছি।” তার শরীর কেঁপে উঠল, অপমান আর অসহায়ত্বের এক তিক্ত মিশ্রণ তার গলা চেপে ধরল। সে ফিসফিস করে বলল,
“উনাকে গিয়ে বলো আমি পারব না।”
নাজমার চোখে একটা মৃদু করুণা ফুটে উঠল। সে ট্রেটা টেবিলে রেখে সিমরানের কাছে এগিয়ে এল।
__“ম্যাডাম, আপনি হয়তো জানেন না, এই বাড়িতে ছোট সাহেবের কথা কেউ অমান্য করতে পারে না। তিনি যা বলেন, তা এখানে আইনের মতো। তিনি রেগে গেলে… আমি এখানে অনেক দিন ধরে আছি, তাই দেখেছি তার রাগ কী ভয়ঙ্কর হতে পারে। আপনি দয়া করে চলুন, আমি আপনাকে সব সাহায্য করব। আপনার কিছু করতে হবে না, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। শুধু তার সামনে গিয়ে একটু হাজির হন, এটাই যথেষ্ট।”
নাজমার কথাগুলো সিমরানের বুকে ছুরির মতো বিঁধল। সে জানে, অরণ্যের হিংস্রতার সামনে তার কোনো ক্ষমতা নেই। তার বাবার জীবন, তার চিকিৎসা—সবকিছু অরণ্যের হাতে বাঁধা। সে চোখ বন্ধ করে গভীর নি:শ্বাস নিয়ে বলল,
__“ঠিক আছে, তুমি যাও, আমি আসছি।”
নাজমা মাথা নাড়ল, তার চোখে একটা অসহায় করুণা। সে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিমরান ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠল। পায়ের ব্যথাটা ভীষন যন্ত্রনা দিচ্ছে, কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চেপে তা হজম করে নিল। পা টেনে টেনে বিশাল বাড়ির মার্বেলের মেঝে পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। এই বাড়ির মতো রান্নাঘরটিও রাজকীয়—চকচকে কাউন্টার, স্টিলের যন্ত্রপাতি, সারি সারি মশলার জার। সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো।
সিমরান পুরো রান্নাঘরটি একবার দেখে নিয়ে নাজমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
__“সকালে উনি কী খান?”
নাজমা একটু হেসে বলল,
__“ছোট সাহেব ছোট সাহেব বেশ খুঁতখুতে স্বভাবের। রান্নায় একটু উনিশ-বিশ হলেই খেতে চান না। তিনি অনেক কিছুই খান না যেমন তেল-মশলার খাবার,  মিষ্টি জাতীয় খাবার একবারেই পছন্দ করেন না।”
সিমরান মাথা নাড়ল। সে স্থির করল, রুটি আর সবজি তৈরি করবে। সে আটা মাখতে শুরু করল,কিন্তু কাজে তার মন কিছুতেই বসছে না। তার চোখের সামনে অরণ্যের সেই নির্লজ্জ হাসি, তার হিংস্র কথাগুলো—বারবার ভেসে উঠছে। সিমরান যখন এসব ভাবছিলো হটাৎ একটা গম্ভীর, পরিচিত কণ্ঠ রান্নাঘরের বাতাসকে ভারী করে দিল।
__“সিমরান, একবার আমার ঘরে আয় তো।”
অরণ্যের ডাকে সিমরানের হাত থমকে গেল। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফিয়ে উঠল, একটা ঠান্ডা ভয় তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল,গলা শুকিয়ে গেছে, সে উত্তর দিতে পারল না।
অরণ্য আবার বলে উঠল, এবার তার কণ্ঠে একটা কর্কশ তীব্রতা ফুটে উঠছে,
__“কী রে, আমার কথা কানে যায়নি? তুই কি ভেবেছিস আমি তোকে ডাকব আর তুই চুপচাপ বসে থাকবি,আমি সেটা মেনে নিব? তুই কি আসবি, নাকি আমাকে নিচে আসতে হবে? আমি যদি নিজে আসি, তাহলে তোর জন্য ভালো হবে না, সিমরান। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না!
অরণ্যের হিংস্র কন্ঠে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল। ভয় আর অসহায়ত্বের এক তীব্র ঢেউ গ্রাস করল তাকে। সে আটার বাটিটা কাউন্টারে রেখে দিয়ে অরণ্যের ঘরের দিকে পা বাড়াল, কিন্তু পায়ের ব্যথা তাকে প্রতি পদক্ষেপে কষ্ট দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখানেই থেমে যেতে, কিন্তু অরণ্যের হিংস্র কণ্ঠ তাকে বাধ্য করল এগিয়ে যেতে। সে পা টেনে টেনে বিশাল বাড়ির নিস্তব্ধ করিডর পেরিয়ে অরণ্যের ঘরের সামনে পৌঁছাল। অরণ্যের ঘরের দরজায় পৌঁছে সে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, কারণ সে জানে, অরণ্যের ডাক মানে নতুন অপমান, তার সম্মানের ওপর আরেকটি আঘাত। তবু সে থামতে পারল না কারণ অরণ্যের হিংস্রতার ছায়া তার পিছু তাড়া করছে। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের মৃদু আলো তার চোখে পড়ল। বিছানার চাদরে কুঁচকানো ভাঁজ, একটা অস্তব্যস্ত শূন্যতা। অরণ্য ঘরে নেই দেখে সিমরানের বুক থেকে যেন একটা ভারী পাথর নেমে গেল। সে দ্রুত পিছু ফিরল আর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। মনে হল, এই সুযোগে সে পালাতে পারবে, পরে আবার ডাকলে অজুহাত দেওয়া যাবে যে আপনি ঘরে ছিলেন না। সিমরান যখন বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা থেকে অরণ্যের কণ্ঠ ভেসে এল। অরণ্য শান্ত, কিন্তু ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বলল,
—“সিমরান, আমার টাওয়ালটা একটু দে তো।”
সিমরান চমকে উঠল। তার হাত কাঁপতে শুরু করল, হৃৎপিণ্ড আবার দ্রুত লাফিয়ে উঠল। সে জানে, এই নির্দেশের পিছনে অরণ্যের আরেকটা নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। তার মন চিৎকার করে বলতে চাইল, “না! আমি যাব না!” কিন্তু তার শরীর বাধ্য হয়ে ঘরের কোণে ঝোলানো টাওয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। সে কাঁপা হাতে টাওয়ালটা তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের অর্ধেক খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ভেতর থেকে পানির ঝিরঝির শব্দ ভেসে আসছে। সিমরান চোখ নিচু করে, কাঁপা হাতে টাওয়ালটা দরজার ফাঁকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
__“এই যে আপনার টাওয়াল। আমি এখানে রেখে যাচ্ছি। দয়া করে নিয়ে নিন।
__”কেন ভিতরে এসে দিয়ে গেলে কি তোর হাতে ফুসকা পড়ে যাবে?
__”না মানে রান্না শেষ হয়নি ভাইয়া, আমাকে রান্নাঘরে যেতে হবে।”
সিমরান কথাটা বলে শেষ করতেই অরণ্যের হাত বেরিয়ে এল, আর এক হ্যাঁচকা টানে সিমরানকে ওয়াশরুমের ভেতর টেনে নিয়ে গেল।সিমরান হকচকিয়ে গেল। পায়ের ব্যথায় ভারসাম্য হারিয়ে সে অরণ্যের বুকে গিয়ে পড়ল। সিমরানকে এই অবস্থায় দেখে অরণ্যের ঠোঁটে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল। সে হেসে বলল,
__“কী রে, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এত তাড়া?কিন্তু আমি তো তোকে যেতে দেব না।”
সিমরান তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, পায়ের ব্যথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, শরীর কাঁপছে। সে চোখ তুলে তাকাল—অরণ্যের ভেজা চুলের ফোঁটাগুলো তার কপাল বেয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে প্রশস্ত বুকের ওপর। চোখে একধরনের গাঢ় নীরবতা, যেন কোনো হারানো অতীতের গল্প লুকিয়ে আছে সেই গভীর দৃষ্টিতে। তার গায়ে কেবল একটি সাদা তোয়ালে, কোমরে আলগোছে বাঁধা—যা সবকিছু ঢেকে রেখেও যেন আরও বেশি উদ্দীপ্ত করে তুলছে।
সিমরান তার দিকে একবার দেখে অস্বস্তিতে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। অরণ্য আবার হাসল,
__“কী রে, লজ্জা পেয়েছিস মনে হচ্ছে? এত লজ্জা কীসের? একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নে সিমরান, তুই এখানে এসেছিস আমার জন্য, আমার ইচ্ছা পূরণ করাই তোর একমাত্র দায়িত্ব তাই এই লজ্জা, এই ভয়—এগুলো তোর কোনো কাজে আসবে না। এখন থেকে তুই আমার সবকিছুতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা কর। আমি চাই তুই আমার মন মতো হয়ে উঠ।
সিমরান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,
__”আমি চেষ্টা করব কিন্তু এখন আমি যাই আপনি গোসল শেষ করুন।
__”এত তাড়া কিসের?আমি তোকে এখানে কেন ডেকেছি তুই জানিস না?”
__”মানে, কেন ডেকেছেন?
__” তুই কি ভেবেছিস আমি তোর এই লজ্জা মাখা ন্যাকামি দেখে থেমে যাব?
সিমরানের গলা শুকিয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল,
__“আমাকে যেতে দিন। খবরদার খারাপ কিছু করার কথা ভুলেও ভাববেন না।
সিমরানের প্রতিবাদে অরণ্য হেসে উঠল। তার চোখে এক অদ্ভুত শীতল আগুন জ্বলে উঠেছে—যা কেবল সিমরানকে জ্বালিয়ে দিতে চাইছে। সিমরান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, গায়ের জামাটা ভিজে গেছে। ভেজা জামাটা শরীরের সাথে এমনভাবে লেপ্টে আছে যে শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জলের আঁচড়ে। ওড়নাটা যেন বারবার সরে যেতে চাইছে। সিমরান এক হাতে আঁচল ঠিক রাখতে ব্যস্ত, কিন্তু তার প্রতিটি নড়াচড়া যেন অরণ্যের চোখে
 তাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলছে। সিমরান ওড়নাটা কোনোমতে ঠিক করে বলে উঠল,
__“এভাবে তাকাবেন না, প্লিজ… আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। আপনার এই দৃষ্টি আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।আপনি জানেন আমি কতটা অসহায়। তারপরেও আপনি আমাকে বারবার ভয় দেখান। আমি আপনার কাছে কিছুই চাই না, শুধু আমাকে একটু আমার মতো থাকতে দিন।”
অরণ্য ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে।
__“তোর দিকে না তাকাব না মানে?তোর দিকে না তাকিয়ে কোথায় তাকাব? তুই বুঝিস না, তুই আমার কাছে কী? তুই আমার জীবনের নতুন একটা অধ্যায় সিমরাম যা আমি নিজের হাতে লিখব। তোর এই ভয়, এই অসহায়তা—আমাকে আরও বেশি টানে। তুই যতই পিছিয়ে যাবি, আমি ততই তোকে কাছে টেনে নিব।”
__”আপনি কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন?
__”আমি কষ্ট দিতে চাইছি না। তোর ভেজা চুল, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট… এসব আমার সমস্ত সংযম ভেঙে দিতে চাইছে, সিমরান!
অরণ্যের গলায় যেন নিষিদ্ধ অথচ অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা মিশে আছে। যা সিমরানকে আরও ভয় পাইয়ে দিল। সে ভয়ে ভয়ে বলল,
__“এমন করবেন না,প্লিজ। আমি আপনাকে সম্মান করতে চাই ভাইয়া, আমি নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি চাইলেই আমাকে সাহায্য করতে পারেন। বিনিময়ে আমি আপনার সব কাজ করে দিব শুধু…
__”শুধু কী…?
__”শুধু খারাপ নজরে আমার দিকে তাকাবেন না। আপনি কেন আমাকে এভাবে ধ্বংস করতে চাইছেন? আমার কী দোষ বলুন? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি।”
অরণ্য আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না, এগিয়ে গেল সিমরানের দিকে, তার হাত সিমরানের কাঁধে রাখল। সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল, সে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দেয়াল তার পথ আটকে দাঁড়াল।’
এক মুহূর্তেই অরণ্য সিমরানের কোমর জড়িয়ে টেনে নিল নিজের বুকের মধ্যে। শাওয়ার থেকে ঝিরঝির করে পানি ঝরছে—জল যেন সাক্ষী এই নীরব টানাপোড়েনের। কাচঘেরা ক্ষুদ্র জগতে দাঁড়িয়ে আছে বিপরীত মেরুর দুটি মানুষ, অথচ—দুজন দুজনের এতটাই কাছে, যেন শরীর নয়, ছায়ারাও জলে গলে এক হয়ে গেছে।
অরণ্য ধীরে ধীরে সিমরানের ভেজা চুলের বাঁধন আলগা করে দিল। তার আঙুল চুল ছুঁয়ে গালের পাশে নেমে যাচ্ছে, অরণ্যের নরম অথচ দখলদার স্পর্শে সিমরান চোখ বন্ধ করে নিল। সিমরানের ঠোঁট কাঁপছে—কিন্তু অরণ্যের ভিজা স্নিগ্ধ ঠোঁটে জমে আছে চুমুর এক অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি।
তাদের মাঝখানে আর কোনো দূরত্ব নেই—দুজন একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছে।
অরণ্য সিমরানের চিবুকে তার আঙুল ছুঁয়িয়ে দিল। তার আঙুল ধীরে ধীরে নেমে আসে সিমরানের বাহুতে, তারপর আরও গভীর, আরও স্পর্শকাতর জায়গায়। যেন এক শিকারি তার শিকারের প্রতিটি কোণ নিরীক্ষা করছে—স্নিগ্ধ অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ ছোঁয়ায়। সিমরানের মনে হয়, তার শরীর আর তার নিজের নেই।অরণ্য অদৃশ্য শিকলের মতো ঘিরে ফেলেছে তাকে
 লজ্জা, ঘৃণা আর অসহায়তায় সে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। অরণ্যের ঠোঁট নামতে সিমরানের কপাল থেকে গাল ছুঁয়ে নামতে শুরু করে সিমরানের গলার কাছাকাছি। তার গরম নিঃশ্বাস ত্বক ছুঁয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, অরণ্যের স্পর্শে সিমরানের শরীর জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে আর সহ্য করতে পারল না।  হঠাৎই তার মনের গভীরে জমে থাকা ক্ষীণ প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। কাঁপা কণ্ঠে, কিন্তু স্পষ্ট ভয়ে, ক্রোধে আর অপমানবোধে সে চিৎকার করে ওঠে,
“থামুন! কী করছেন এসব? আপনি কি মানুষ না পশু? আমি আপনাকে আর কতবার বলব, আমাকে এভাবে স্পর্শ করবেন না? আমার শরীর আমার নিজের, আমি আপনার ইচ্ছার পুতুল নই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top