সারারাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারেনি সিমরান। রাতটা কেটেছে চরম অস্থিরতায়।
টেবিলের ওপর রাখা কালো-সোনালি কার্ডটা যেন জীবন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, প্রতি মুহূর্তে অরণ্যের ঘৃণ্য প্রস্তাবের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সকাল হতে না হতেই সিমরান প্রতিটি সম্ভাব্য দরজায় কড়া নাড়ল—বন্ধু, আত্মীয়, এমনকি দূরের পরিচিতদের কাছেও সাহায্য চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে এসেছে শূন্য হাতে।
চেষ্টার শেষ সীমায় পৌঁছে সিমরান ক্লান্ত শরীরে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াল। হাসপাতালের ঠান্ডা, নীরব করিডোরে পৌঁছতেই তার বাবার কষ্টে কাতর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। সেই মুহূর্তে তার মনের ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, “বাবাকে বাঁচাতে হবে। যে কোনো মূল্যে বাবাকে বাঁচাতে হবে।”
সিমরান আর ভেতরে গেল না। হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার চোখে জল টলটল করছিল। সে বাড়ি ফিরে এল। ঘরে ঢুকতেই টেবিলের ওপর রাখা সেই কার্ডটা তার চোখে পড়ল। তার বুক কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল অরণ্যের,তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেওয়া সেই মুহূর্ত, তার উষ্ণ নিশ্বাস, তার শীতল কণ্ঠের বিষাক্ত মাধুর্য। সিমরান জানে, এই পথ বেছে নেওয়ার মানে নিজের সবকিছু বিকিয়ে দেওয়া। কিন্তু তার বাবার জীবন বাঁচাতে হলে এটাই তার শেষ উপায়।
তার হাত কেঁপে উঠল মনে মনে সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, “এটা শুধু সাহায্য চাওয়ার জন্য।” কিন্তু তার ভেতরের ভয় তাকে বলছিল, এই কার্ড তাকে এমন এক অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। তবু, বাবার কথা ভেবে সে আর দ্বিধা করল না। কাঁপা হাতে কার্ডে থাকা নম্বরে ফোন করল।
অপর প্রান্ত থেকে একটা পেশাদার কণ্ঠ ভেসে এল,
__“স্কাইলাইন কর্পোরেশন থেকে বলছি। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
সিমরান গলা পরিষ্কার করে বলল,
__“আমি সিমরান। আমি… অরণ্য স্যারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
কিছুক্ষণের নীরবতার পর অরণ্য নিজেই ফোন ধরল। তার গলায় একটা অদ্ভুত উষ্ণতা, যেন সে এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল।
“আমি জানতাম আপনি ফোন করবেন। কী ব্যাপার, বলুন।”
সিমরানের মাথায় হঠাৎ ঝড় উঠল। গতরাতের ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে বদলে যাওয়া কণ্ঠ তাকে বিভ্রান্ত করল, কিন্তু সে সেদিকে মন না দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আ-আমি… আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি।”
অরণ্য একটু চুপ করে রইল, যেন সিমরানের কথাগুলো ওজন করছে। তারপর তার কণ্ঠে একটা বিজয়ী আনন্দ ফুটে উঠল।
“ভেবে বলছেন? পরে আবার মত পাল্টাবেন না তো?”
“জ-জি না,” সিমরানের গলা কেঁপে গেল। “কিন্তু আমার বাবার চিকিৎসা… দয়া করে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন।”
“চিন্তা করবেন না,” অরণ্যের কণ্ঠে একটা শীতল নিশ্চয়তার সুর বেজে উঠল।
“আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তবে তার আগে আপনি আমার অফিসে চলে আসুন। সামনাসামনি বিস্তারিত কথা বলা দরকার।”
সিমরানের বুকের ভেতর একটা ভারী পাথর চেপে বসল। সে ফোন কেটে দিয়ে টেবিলের পাশে বসে পড়ল। তার হাতে কার্ডটা কাঁপছিল।
ঘরের নিস্তব্ধতায় তার নিজের হৃৎস্পন্দনই যেন ঢেউয়ের মতো কানে বাজছিল। সে জানে,এই পদক্ষেপের পর আর ফিরে আসার পথ থাকবে না। তবু, বাবার জন্য, সে এই অন্ধকার পথে পা বাড়ানোর সিধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। সে এটাও জানে এই সিদ্ধান্ত তার জীবনকে চিরতরে বদলে দেবে।এই পথে পা বাড়ানোর মূল্য যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা তার হৃৎপিণ্ড তাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এছাড়া তার কাছে আর কোন রাস্তা খোলা নেই।
স্কাইলাইন কর্পোরেশনের বিশাল কাচের ভবনটার সামনে দাঁড়িয়ে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল। ভবনের ঝকঝকে চেহারা যেন অরণ্যের মতোই ঠান্ডা, নিয়ন্ত্রিত, আর ভয়ংকর। রিসেপশনে তার নাম বলতেই তাকে সরাসরি অরণ্যের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। বিশাল কক্ষে, কাচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য। সিমরান ঢুকতেই সে ঘুরে তাকাল, তার ঠোঁটে সেই পরিচিত বাঁকা হাসি।
__“বসুন, মিস সিমরান,আমি জানতাম আপনি আসবেন।”
সিমরান চেয়ারে বসল,হাতের মুটো শক্ত করে চেপে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। তার গলা শুকিয়ে গেল, কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করে বলল,
“আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমি রাজি হলে বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিবেন। আমি চাই, এখনই সব ব্যবস্থা হয়ে যাক।”
অরণ্য একটা ভ্রূ তুলল, তার চোখে একটা কৌতুক মিশে গেল।
__ “এত তাড়াহুড়ো?আপনার জানতে ইচ্ছা করছে না, শহরে এত মেয়ে থাজতে আমি কেন আপনাকে চাই?” তার কণ্ঠে একটা রহস্যময় আভাস ছিল, যেন সে একটা গোপন উদ্দেশ্য লুকিয়ে রেখেছে।
সিমরানের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল।
__ “কেন?” সে ফিসফিস করে প্রশ্ন করল, তার চোখে সন্দেহ আর ভয় মিশে গেল।
অরণ্য ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে এল, তারপর বলল,
“কারণ অপ্রিয় হলেও সত্যি তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে। তুমি আমার কাজিন,তুমি আমার একমাত্র খালাতো বোন”
অরন্যের কথায় সিমরানের শরীর যেন বরফ হয়ে গেল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
“কী… কী বলছেন আপনি?” তার কণ্ঠ কাঁপছিল, তার মাথায় শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। “এটা… এটা কীভাবে সম্ভব?”
অরণ্য পিছনে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, তার মুখে একটা অন্ধকার তৃপ্তি।
“ যা শুনেছো ঠিক শুনেছো যাইহোক এখন সেসব কথা বাদ দাও আর সেই সম্পর্কও ভুলে যাও। চিন্তা করো না। আমি কখনো কাউকে কোন কথা দিলে,সেই কথা রাখি।তোমার বাবার চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছে।
সে টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজের ফাইল তুলে নিয়ে সিমরানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
__ “তবে তার আগে, একটা ছোট আনুষ্ঠানিকতা বাকি। চুক্তিপত্রটা,পড়ে দেখো তারপর সই করো”
সিমরানের কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা খুলল। কাগজে লেখা শব্দগুলো তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছিল। চুক্তিপত্রে স্পষ্ট লেখা আছে—তার বাবার চিকিৎসার সমস্ত খরচ অরণ্য বহন করবে, কিন্তু বিনিময়ে সিমরানকে অরণ্যের “ব্যক্তিগত সঙ্গী” হিসেবে থাকতে হবে।এছাড়াও আরও অনেকগুলো শর্ত। চুক্তিপত্রের প্রতিটি শর্ত সিমরানের হৃৎপিণ্ডে ছুরির মতো বিঁধল। সে মাথা তুলে অরণ্যের দিকে তাকাল, তার চোখে অশ্রু টলটল করে উঠল
__“এটা… এটা কি আমাকে আপনার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার চুক্তিপত্র?”
অরণ্য হাসল, তার হাসিতে কোনো সহানুভূতি ছিল না।
__” না, এটা একটা বোঝাপড়া।তুমি আমাকে কিছু দিবে বিনিময়ে আমি তোমাকে কিছু দিব এটাই ন্যায্য হিসাব। বলে সে কলমটা এগিয়ে দিল। “সই করো”।
__” আপনি আমার পরিবারের একজন হয়ে হয়ে কি করে এমন প্রস্তাব দিচ্ছেন? আপনার লজ্জা করছে না?
—“গত ১৫ বছরে যার সাথে দেখা হয়নি কথা হয় নি সে পরিবারের একজন হয় কিভাবে? আমার এত কথা বলার সময় নেই রাজি থাকলে সই করো আর রাজি না থাকলে বেরিয়ে যাও।
অরন্যের কঠোর শর্তে সিমরান হার মানতে বাধ্য হল। কাঁপা কাঁপা হাতে কলমটা তুলে নিল। তার মন চিৎকার তাকে থামতে বলছিল কিন্তু তার বাবার মুখ, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা সেই দুর্বল শরীর, তাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। প্রতিটি অক্ষর সই করার সময় সিমরান্রর হৃৎপিণ্ড যেন থেমে যাচ্ছিল। কাগজে কালি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল।
সই করা শেষ হতেই অরণ্য ফাইলটা তুলে নিল। তার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি।
–“ কংগ্রাচুলেশনস , মিস সিমরান। আজ থেকে আগামী ছয়মাসের জন্য আপনি আমার,আর আপনার সমস্ত দায়িত্ব আমার!
সিমরান তার হাত ঝেড়ে ফেলল, কিন্তু কিছু বলল না। সে উঠে দাঁড়াল, আর অফিস থেকে বেরিয়ে আসলো। অফিস থেকে বেরিয়ে সে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল। বাড়ি পৌঁছে সে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
অরণ্য তার কথা রেখেছে। সন্ধ্যার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফোন এল—সিমরানের বাবার অপারেশনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সেরা হাসপাতাল, সেরা ডাক্তার—সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু সিমরানের মন শান্ত হল না। তার বাবার জীবন বাঁচলেও, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। চুক্তিপত্রে সই করার মুহূর্তটা তার মনে বারবার ফিরে আসছিল।
সন্ধ্যার ম্লান আলো ঘরে ঢুকছে। সিমরান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। হঠাৎ বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দে তার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, একটা কালো, ঝকঝকে গাড়ি তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার নেমে এসে দরজায় কড়া নাড়ল। সিমরানের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে শুরু করল। দরজা খুলতেই ড্রাইভার শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ম্যাডাম, অরণ্য স্যার আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন।”
সিমরানের মন চিৎকার করে উঠল, “না, আমি যাব না!” কিন্তু চুক্তিপত্রের কথা তার মনে পড়ল। কাগজে স্পষ্ট লেখা ছিল—আগামী ছয় মাস অরণ্যের ব্যক্তিগত সঙ্গী হিসেবে তাকে অরণ্যের বাড়িতে থাকতে হবে। তার বাবার জীবনের বিনিময়ে সে এই শর্তে সই করেছে। এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
সিমরান একটা ছোট ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। প্রতিটি পদক্ষেপে তার শরীর ভারী হয়ে আসছিল, যেন সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক অজানা অন্ধকার পথে হাঁটছে।
বাড়ির দরজা বন্ধ করার সময় তার চোখ টলটল করে উঠল। সিমরান জানে এই বাড়ি, যেখানে তার বাবার স্মৃতি, তার শৈশবের হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে, সেটা ছেড়ে সে আজ যে অবস্থায় বেরিয়ে যাচ্ছে, এই অবস্থায় আর ফিরতে পারবে না। এরপর সবকিছু বদলে যাবে—পরিবেশ, পরিস্থিতি, এমনকি সিমরান নিজেও। তবুও নিজেকে শক্ত করে, ড্রাইভারের পেছন পেছন গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। দরজার ভেতরে তাকাতেই সিমরানের শ্বাস আটকে গেল। কারণ গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে অরণ্য। তার গায়ে সাদা শার্ট, চকচকে কালো স্যুট, আর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাতের অন্ধকারে আরও ভয়ংকর মনে হল। সিমরান ভেবেছিল অরণ্য শুধু গাড়ি পাঠিয়েছে; সে নিজে আসবে, এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। তার পা থমকে গেল, চোখে অবিশ্বাস আর ভয় মিশে গেল।
“কী হল, মিস সিমরান? থেমে গেলে কেন? উঠে এসো,” অরণ্য বলল, তার কণ্ঠে একটা শান্ত, কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ সুর। তার ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি, যেন সে সিমরানের প্রতিটি আবেগ উপভোগ করছে।
সিমরানের গলা শুকিয়ে গেল। “আপনি… আপনি এখানে?আমি ভেবেছিলাম শুধু গাড়ি…”
অরণ্য হাসল। “বলেছি না, এখন থেকে তুমি আমার। তোমার সমস্ত দায়িত্বও আমার। তাহলে তোমাকে একা ছাড়ব কীভাবে? কেন শুধু গাড়ি পাঠাব? আমি নিজে এসেছি, তোমাকে আমার জগতে স্বাগতম জানানোর জন্য।”
সিমরান কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার পা যেন মাটিতে আটকে গেল। অরণ্য আবার একটু হেসে বলল, “চুক্তি তো তুমি মেনেই নিয়েছ। এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। চলে এসো।”
কাঁপা পায়ে সিমরান গাড়িতে উঠল। গাড়ির ইঞ্জিনের নিচু গর্জন রাতের নিস্তব্ধতায় মিশে গেল। সিমরান অরণ্যের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে পেছনের সিটের এক কোণে গুটিয়ে বসল। অরণ্যের উপস্থিতি তার পাশে একটা অদৃশ্য শিকলের মতো মনে হচ্ছিল।
অরণ্য হঠাৎ ঘুরে তাকাল, তার চোখে একটা অধৈর্য ভাব ফুটে উঠল। সে কঠিন কণ্ঠে বলল, “ওখানে নয়, আমার কাছে এসে বসো।”
সিমরানের বুক কেঁপে উঠল। সে মাথা তুলে অরণ্যের দিকে তাকাল, তার চোখে ভয় আর প্রতিরোধের একটা ক্ষীণ চিহ্ন ফুটে উঠল। “আমি এখানেই ঠিক আছি,”
অরণ্যের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল, মুখ কঠিন হয়ে গেল।
“তুমি ঠিক থাকলেও আমি ঠিক নেই, আমি যখন কিছু বলব, তুমি চুপচাপ তা পালন করবে। এটাই তোমার দায়িত্ব। আমার সঙ্গে কখনো দ্বিমত পোষণ করবে না। তোমাকে আমার পাশে বসতে বলেছি তুমি চুপচাপ পাশে এসে বসবে।”
সিমরান অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, তার চোখে অবিশ্বাস আর ক্রোধ মিশে গেল।
“আমি তো কাছেই বসেছি।”
অরণ্যের মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল। সে সিমরানের দিকে ঝুঁকে বলল,
“পাশে বসতে বলেছিলাম, তোমার ভালো লাগেনি? ওকে, ফাইন। এখন আমার কোলে এসে বসো।”
সিমরান মৃদু চিৎকার করে বলল,
“আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? কী বলছেন এসব?”
“বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়, সিমরান। যা বললাম, তাই করো,” অরণ্যের কণ্ঠে একটা হিমশীতল কঠোরতা ফুটে উঠল।
“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, গাড়িতে ড্রাইভার আছে!” সিমরান ফিসফিসিয়ে বলল, তার গলা কাঁপছিল।
অরণ্যের কঠিন কন্ঠে বলে উঠল,
“তুমি যদি এভাবে আমার সঙ্গে তর্ক করো, তাহলে আমি এখনই হাসপাতালে ফোন করব।” সে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াল।
সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার চোখে ভয় আর অসহায়ত্ব ঝলসে উঠল।
“না, ফোন করবেন না, প্লিজ! আমি… আমি বসছি।”
কাঁপা হাতে সিমরান অরণ্যের পাশে সরে এল। তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল, প্রতিটি নিশ্বাস যেন যুদ্ধ করছিল। অরণ্য ফোনটা পকেটে রেখে হঠাৎ হ্যাচকা টানে সিমরানকে নিজের কোলে তুলে নিল। সিমরান হকচকিয়ে উঠল, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারল না। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে ড্রাইভারের দিকে তাকাল, যদিও ড্রাইভার সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু তার উপস্থিতি সিমরানকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছিল। সে ফিসফিসিয়ে বলল, “ড্রাইভারের সামনে… আপনি এসব কী করছেন?”
অরণ্যের ভ্রূ কুঁচকে গেল। সে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “ড্রাইভার, গাড়ি থামাও!”
গাড়ি রাস্তার পাশে থামতেই অরণ্য ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। ড্রাইভার কোনো কথা না বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেল, দরজা বন্ধ করে দূরে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতরে এখন শুধু অরণ্য আর সিমরান।
অরণ্য সিমরানের দিকে ঝুঁকে, তার চোখে তীব্র দৃষ্টি রেখে বলল, “এবার আর কোনো অজুহাত নেই। Now kiss me.”
অরন্যের কথায় সিমরানের শরীর যেন জমে বরফ হয়ে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বলছেন এসব?”
অরণ্যের চোখে একটা ভয়ংকর শীতলতা ফুটে উঠল। সে ধীর কণ্ঠে বলল, “আমাকে রাগিও না, সিমরান। তুমি জানো আমি কী করতে পারি। এখন আমার কথা না মানলে তোমার বাবার চিকিৎসার কথা ভুলে যাও।”
সিমরানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। তার মনের ভেতর একটা তীব্র যুদ্ধ চলছিল—বাবার জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব আর নিজের সম্মানের মধ্যে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অরণ্যের হুমকির সামনে তার আর কোনো উপায় ছিল না। কাঁপা হাতে সে অরণ্যের কাছে ঝুঁকল, চোখ বন্ধ করে দিল। তার শরীর কাঁপছিল, মনের ভেতর ঘৃণা আর অসহায়ত্বের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
অরণ্য তার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলে উঠল, “এই তো, এবার ঠিম আছে। একটা কথা মনে রেখো আমার মনোরঞ্জন করাই তোমার দায়িত্ব। তুমি আমার কথা মেনে নিলে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে।”
গাড়ির ভেতরের নিস্তব্ধতা যেন সিমরানের হৃৎপিণ্ডের দ্রুত ধুকপুকের শব্দকে আরও তীব্র করে তুলল। অরণ্যে সিমরানের এতটাই কাছে ছিল যে তাদের নিঃশ্বাস একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। সিমরানের শরীর বরফের মতো জমে যাচ্ছে। তার চোখ বন্ধ, হাত কাঁপছে, আর মনের ভেতর একটা অসহায় চিৎকার তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। অরণ্যের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার গালে লাগছে, ধীরে ধীরে অরন্যের ঠোঁট সিমরানের ঠোঁটের এতটাই কাছে নেমে এলো যে মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে অরন্য তাকে চুমু খাবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অরণ্য থেমে গেল।
তার ঠোঁটে সেই পরিচিত বাঁকা হাসি ফুটে উঠল সিমরানকে তার কোল থেকে নামিয়ে পাশের সিটে বসিয়ে দিল। তার হাত এখনও সিমরানের কাঁধে হালকাভাবে স্পর্শ করছিল, যেন সে তার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায় না।
অরণ্য সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এরপর থেকে আমার সঙ্গে আর তর্ক করবে না, আশা করছি।”
কথাগুলো সিমরানের কানে বাজের মতো বাজল। তার মনে হল, যেন একটা অদৃশ্য শিকল তার চারপাশে আরও শক্ত হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। অরণ্যের কথায় কোনো আবেগ ছিল না, শুধু একটা ঠান্ডা নির্দেশ, যা তার ক্ষমতার দম্ভকে আরও স্পষ্ট করে তুলল। সিমরানের চোখের জল লুকানোর জন্য মাথা নিচু করে নিল। তার মনের ভেতর একটা ঝড় বয়ে গেল—সিমরান আন্দাজ করতে পারল, এই মুহুর্ত থেকে তার জীবনে কী এক দুর্বিষহ অধ্যায়ের শুরু হতে চলেছে।
Pingback: Opurno Prem Part 6 | Love Thriller Story - Mdigitech
Pingback: Opurno Prem Part 7 | Love Romance Story - Mdigitech