অরণ্য চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সিমরান আজাদ চৌধুরীর ঘরে চা নিয়ে গেল। তার এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। আজাদ চৌধুরী, অরণ্যের বাবা, বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তার মুখে একটা কঠোর, অপছন্দের ভাব। সিমরান চুপচাপ কাপটা টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল, কিন্তু আজাদ চৌধুরী তাকে থামিয়ে দিলেন।
__“থামো! তোমার হাতের কিছু আমি খাব না,” তিনি কর্কশ কণ্ঠে বললেন। “অরণ্য যে তোমাকে এখানে এনেছে, সেটা আমার পছন্দ নয়। শুধুমাত্র ওর জেদের জন্য মেনে নিয়েছি কিন্তু তুমি এই পরিবারের একজন হয়ে ওঠার চেষ্টাও করোনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো আর এখন এখান থেকে বেরিয়ে যাও। আর কখনো আমার ঘরে আসবে না।”
অরণ্যের বাবার কথায় সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনে হল, এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ তার অস্তিত্বকে অপমান করতে বদ্ধপরিকর। সে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল, তার হাতে চায়ের কাপটা এখনো কাঁপছে।
সিমরান নিজের ঘরে ফিরে সে বিছানার এক কোণে গুটিয়ে বসল। তার চোখে অশ্রু শুকিয়ে গেছে, কিন্তু মনের ভেতরের ঝড় থামেনি। সকালের ঘটনা—অরণ্যের বাবার কথা, অরণ্যের প্লেট ছুঁড়ে ফেলা, গার্ডদের কঠোর নজরদারির হুকুম—সবকিছু তার মনে একের পর এক আঘাত হানছে। রাত থেকে কিছুই খায়নি মেয়েটা। যদিও তার ক্ষুধা পেয়েছে কিন্তু খাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। সকাল থেকে সে এক ফোঁটা জলও মুখে দেয়নি। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পায়ের ব্যথা কিছুটা কমলেও মনের ব্যথা তার শরীরকেও ছাড়িয়ে গেছে।
সে ধীরে ধীরে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে শহরের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, মানুষের কথার শব্দের মাঝে একমাত্র সেই নিস্তব্ধ। তার মনে হচ্ছে তার জীবনের রঙ যেন মুছে গেছে, যেন সে একটা ধূসর কারাগারে বন্দী।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে তার ফোন বেজে উঠল। সিমরান চমকে উঠে ফোনের দিকে তাকাল। স্ক্রিনে একটা অচেনা নম্বর। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফিয়ে উঠল, একটা অজানা ভয় তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁপা হাতে সে ফোন তুলে নিল।
__“হ্যালো কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে একটা পেশাদার, কিন্তু নরম কণ্ঠ ভেসে এল।
__“মিস সিমরান? আমি সিটি হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনার বাবার অপারেশন সফলভাবে হয়ে গেছে। তার অবস্থা এখন স্থিতিশীল। আপনি চাইলে এখন দেখা করতে পারেন।”
কথাগুলো শুনে সিমরানের হৃৎপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার চোখে অশ্রু জমল, কিন্তু এবার তা ছিল আনন্দের, আশার। “বাবা ঠিক আছেন?” সে ফিসফিস করে বলল, যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
__“হ্যাঁ, ম্যাডাম। তবে তাড়াতাড়ি আসুন, দর্শনের সময় সীমিত।”
ফোন কেটে গেল। সিমরানের শরীরে যেন নতুন প্রাণ ফিরে এল। তার হাত কাঁপছে, কিন্তু এবার তা ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। বাবাকে দেখতে পাবে—এই ভাবনা তার মনের অন্ধকারে একটা ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে দিল। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল, ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে শুরু করল। তার হাত এখনও কাঁপছে, কিন্তু তার পায়ের তলায় যেন ডানা গজিয়েছে। সে শাড়ি পরে, চুল বেঁধে, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
দরজা পর্যন্ত যেতেই তার পথ আটকে দাঁড়াল দুজন গার্ড। তাদের মুখ কঠোর, চোখে কোনো আবেগ নেই। একজন গার্ড বলল,
__“ম্যাডাম, প্লিজ ভিতরে যান। অরণ্য স্যারের নির্দেশ, আপনি বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না।”
সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার হৃৎপিণ্ড আবার ভারী হয়ে এল। বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে যেন কেউ তার আশার আলোটুকু কেড়ে নিতে চাইছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“আমার বাবার অপারেশন হয়েছে। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। প্লিজ, আমাকে যেতে দিন। অরণ্য ভাইয়া ফিরে আসার আগেই আমি ফিরে আসব।”
গার্ডরা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের মুখে দ্বিধা, কিন্তু অরণ্যের কঠোর নির্দেশ তাদের বাধা দিচ্ছে। সিমরানের চোখে অশ্রু টলমল করে উঠল। সে হাত জোড় করে বলল,
__ “আমার বাবা খুব অসুস্থ। তার অপারেশন হয়েছে, আমি শুধু তাকে একবার দেখতে চাই। আমি কথা দিচ্ছি, আমি ফিরে আসব। প্লিজ, আমাকে যেতে দিন।”
তার কণ্ঠে এমন একটা কাতরতা ফুটে উঠল যে গার্ডদের মধ্যে একজনের মন নরম হল। সে একটু দ্বিধা করে বলল,
__“ঠিক আছে, ম্যাডাম। কিন্তু আপনাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। স্যার ফিরে এলে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।”
সিমরান দ্রুত মাথা নাড়ল।
__“অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। অরণ্য ভাই ফিরে আসার আগেই আমি চলে আসব।” তার কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বাড়ির গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা রিকশা নিয়ে সে হাসপাতালের দিকে রওনা দিল। রিকশার চাকার শব্দ, বাইরের কোলাহল—সবকিছু যেন তার মনের আশার সঙ্গে মিশে গেল। কিন্তু তার মনের গভীরে এক ভয় তাকে তাড়া করছে। অরণ্য ফিরে এলে কী হবে? সে জানে, এই ক্ষণিকের স্বাধীনতার মূল্য তাকে বড় করে দিতে হবে।
হাসপাতালের গেটের সামনে পৌঁছে সে রিকশা থেকে নামল। তার চোখে অশ্রু, কিন্তু ঠোঁটে একটা ক্ষীণ হাসি। সে মনে মনে বলল,
__“বাবা, আমি এসেছি। তুমি ঠিক হয়ে যাও, তাহলেই আমি এই খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাব।” তার পা দ্রুত হাসপাতালের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। হাসপাতালের সাদা করিডর, অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ, আর নার্সদের ব্যস্ততা তার চারপাশে ঘিরে ধরল। কিন্তু সে সবকিছুকে পেছনে ফেলে ছুটে গেল। কেবিনের দরজায় পৌঁছে সে থমকে দাঁড়াল। দরজার ফাঁক দিয়ে তার বাবাকে দেখল—বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। চোখ বন্ধ, মুখে ক্লান্তির ছাপ। সিমরানের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকল, তার হাত বাবার হাতের ওপর রাখল। সে ফিসফিস করে বলল,
__“বাবা,”
তার বাবা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। তার মুখে একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল।
__“সিমরান, মা, তুই এসেছিস?” তার কণ্ঠ দুর্বল, কিন্তু তাতে ছিল অপার স্নেহ।
সিমরান মাথা নাড়ল, তার চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে এলো।
__“হ্যাঁ, বাবা। আমি এখানে আছি। তুমি এখন ঠিক হয়ে যাবে।”
অন্যদিকে অরণ্য অফিসের কাচের দরজা ঠেলে তার কেবিনে ঢুকল। তার মুখে সকালের সেই কঠোর ভাব এখনও লেগে আছে, যেন সিমরানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার মনের ভেতর এখনও ঝড় তুলছে। সে তার ডেস্কে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখে একটা অস্থিরতা ফুটে উঠল, যেন তার নিষ্ঠুরতার মুখোশের পিছনে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। সে শুভকে তার কেবিনে ডাকল।
শুভ, অরণ্যের বন্ধু এবং অফিসের ম্যানেজার। শুভর সঙ্গে অরণ্যের বন্ধুত্ব ভার্সিটির দিন থেকে, এবং অফিসে তার ওপর অরণ্যের অন্ধ ভরসা। অরণ্যের অনুপস্থিতিতে শুভই কোম্পানির হাল ধরে। অরণ্যের ডাকে শুভ দ্রুত তার কেবিনে ঢুকল। কেবিনে ঢুকেই শুভ অরণ্যের মুখের দিকে তাকাল। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। অরণ্যের চোখে একটা অস্বাভাবিক ক্রোধ আর অস্থিরতা স্পষ্ট। শুভ একটু হেসে বলল,
__“কী ব্যাপার, অরণ্য? মেজাজ চটে আছে দেখছি। কী হয়েছে?”
অরণ্য ডেস্কে হেলান দিয়ে বসল, তার হাতে একটা কলম ঘুরছে। সে একটু থেমে, শান্ত কিন্তু ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
__“তেমন কিছু না। একটা ফ্লাওয়ার বুকেট আর কিছু চকলেট অর্ডার দে তো।”
শুভ অবাক হয়ে ভ্রু তুলল।
__“হঠাৎ এসব কী ব্যাপার, বলতো?” তার কণ্ঠে কৌতূহল, সঙ্গে একটা হালকা হাসি। “এত বছর ধরে তোকে দেখছি, তুই তো কখনও ফুল-চকলেটের পেছনে পড়িস না। ঘটনা কী, কার জন্য এসব?”
অরণ্য একটু হাসল, কিন্তু তার হাসিতে উষ্ণতার বদলে এক রহস্য লুকিয়ে আছে। সে বলল,
__”সিমরানের সঙ্গে ঝামেলা করে অফিসে এসেছি। এখন তার রাগ ভোলাতে হবে।”
শুভর চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল মিশে গেল। সে চেয়ারে বসে পড়ল, দৃষ্টি অরণ্যের ওপর স্থির রেখে বলল
__“সিমরান? এত সকালে সিমরানকে তুই কোথায় পেলি?”
__”কোথায় আবার পাবো, বাড়িতেই ছিল।”
__”কি বলছিস? সিমরান তোর বাড়িতে? সিমরান তোর বাড়িতে এলো কী করে?”
তার কণ্ঠে অবিশ্বাস, যেন অরণ্যের কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
__”এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। ও এখন থেকে আমাদের বাসাতেই থাকবে।”
__”কি বলছিস এসব? এটা কী করে সম্ভব, তুই ওকে রাজি করালি কী করে?”
অরণ্য একটু থামল, তার চোখে একটা দূরের ভাব।
__“সে অনেক লম্বা কাহিনি। পরে বলব।”
শুভ হাল ছাড়ল না। সে হেসে বলল,
__“কী ব্যাপার, অরণ্য? ভার্সিটির দিন থেকে শুরু করে এই অফিস পর্যন্ত কত মেয়ে তোর পেছনে ঘুরেছে। তুই কখনো কারও দিকে ঘুরেও তাকাসনি। এই সিমরানের মধ্যে কী এমন পেলি যার জন্য ফুল-চকলেট অর্ডার করছিস? তুই কি তবে সত্যিই ওর প্রেমে পড়ে গেছিস?”
অরণ্যের মুখে একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু তার চোখে কোনো উষ্ণতা নেই। সে কলমটা ডেস্কে রেখে দিয়ে বলল,
__“প্রেম? হয়তো। কিন্তু এটা ঠিক সেরকম প্রেম না, যেমন তুই ভাবছিস। এটা নিষিদ্ধ প্রেম।” তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত রহস্য, যেন সে কিছু লুকিয়ে রাখছে।
__”নিষিদ্ধ প্রেম?”
__“এটাকে খেলাও বলতে পারিস, এমন একটা পাজল গেম যার নিয়ম বোঝা সহজ নয়। কিন্তু আমি এই খেলাটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই। আর এই ফুল-চকলেট? এটা শুধু খেলার একটা অংশ।”
শুভ ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
__“খেলা? তুই কী বলছিস, অরণ্য? তুই মেয়েটার সঙ্গে খেলছিস? এটা কী ধরনের কথা?” তার কণ্ঠে একটা অস্বস্তি ফুটে উঠল, যেন অরণ্যের কথাগুলো তার ভালো লাগছে না।
অরণ্য হাসল, এবার তার হাসিতে নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠল,
__“শুভ, তুই আমাকে চিনিস। আমি যা চাই, তা আদায় করে ছাড়ি। সিমরানের বাবার অপারেশনের টাকা আমি দিয়েছি। বিনিময়ে ও আমার সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছে। এখন সে আমার কথা মানতে বাধ্য। কিন্তু…”
অরণ্য একটু থামল, তার চোখে একটা অদ্ভুত চিন্তা ফুটে উঠল।
“কিন্তু সিমরান একটু বেশিই প্রতিবাদী। তাই ওর ভিতরের এই প্রতিবাদী সত্ত্বাটাকে আমার ভাঙতে ইচ্ছা করছে। এই ফুল-চকলেট সেই খেলার একটা অংশ।”
শুভর মুখে একটা অস্বস্তি ফুটে উঠল।
__“অরণ্য, তুই এসব কী বলছিস? এটা ঠিক না। মেয়েটার জীবন নিয়ে তুই খেলতে পারিস? তুই কি সত্যিই এতটা নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস?”
অরণ্যের চোখে একটা ঠান্ডা দৃষ্টি।
__“নিষ্ঠুর? হয়তো। কিন্তু এই জগতে বেঁচে থাকতে হলে নিষ্ঠুর হতে হয়, শুভ। তুই জানিস, আমি হারতে শিখি না।”
সে ডেস্কে হেলান দিয়ে বলল,
“এখন আর কথা না বাড়িয়ে ফুল আর চকলেটের ব্যবস্থা কর।”
শুভ আর কিছু বলল না। তার মুখে একটা অসহায় ভাব। সে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু তার মনের ভেতর অস্বস্তি ভর করেছে। অরণ্যের এই রূপ তার কাছে নতুন নয়, কিন্তু এবার তা যেন একটু বেশিই গাঢ় হয়ে উঠেছে। সে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল, কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছে—অরণ্য এসব কেন করছে?
শুভ বেরিয়ে যেতেই অরণ্য নিজের ফোন হাতে নিল। তারপর সিমরানের নম্বরে কয়েকবার কল করল কিন্তু ফোনটা সুইচ অফ দেখাচ্ছে। সিমরানকে ফোনে না পেয়ে অরণ্য বাসার ল্যান্ডলাইনে কল করলো।
চৌধুরী বাড়ির নিস্তব্ধতা ভাঙল ল্যান্ডলাইন ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে। নাজমা তখন মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা প্লেটের টুকরোগুলো সাবধানে তুলছিল। সকালের ঘটনা—অরণ্যের রাগ, সিমরানের অশ্রু, আর ভাঙা প্লেটের শব্দ—তার মনে এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে। ফোনের শব্দে তার হাত থমকে গেল। সে দ্রুত হাত মুছে, পায়ে পায়ে ফোনের কাছে গেল। ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে অরণ্যের কঠোর কণ্ঠ ভেসে এল,
__“নাজমা, সিমরান সকালে খেয়েছে?”
নাজমার বুক ধড়ফড় করে উঠল। অরণ্যের কণ্ঠে সেই পরিচিত তীক্ষ্ণতা, যা তার ভেতরে একটা অজানা ভয় জাগিয়ে তুলল। সে আমতা আমতা করে বলল,
__“না, মানে… ভাইজান, ম্যাডাম খাননি।”
__“জানতাম ও খাবে না,” অরণ্যের কণ্ঠে একটা অধৈর্য্য ফুটে উঠল, “ওর জন্য খাবার তৈরি করো যাই আর ওকে একটু ডেকে দাও তো। বলো আমি কথা বলতে চাইছি।”
নাজমার ভয় এবার আরও গাঢ় হয়ে গেল। সে জানে, সিমরান বাড়িতে নেই। হাসপাতালে গেছে, তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু এই সত্যি বলার সাহস তার হল না। অরণ্যের ক্রোধের সামনে সে নিজেও অসহায়। তার মুখ দিয়ে কথা বের হল না, হাতে ফোন ধরে সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল।
__“কী হল, নাজমা?” অরণ্যের কণ্ঠ আরও ধারালো হয়ে উঠল। “তুমি কথা বলছ না কেন? সিমরান কোথায়?”
নাজমার গলা শুকিয়ে গেল। তার হাত কাঁপছে, ফোনটা প্রায় হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“ভাইজান… আমি… মানে…”
__“চুপ করো! এত আমতা আমতা করছ কেন?” অরণ্য ধমকে উঠল, তার কণ্ঠ আরও তীব্র হয়ে উঠল “তুমি কী লুকোচ্ছ? সিমরান কোথায়? এখনই বলো!”
নাজমার হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে, কিন্তু অরণ্যের ধমকের সামনে সে আর চুপ থাকতে পারল না। সে ফিসফিস করে বলল,
__“ম্যাডাম… বাড়িতে নেই, ভাইজান।”
অরণ্য চিৎকার করে উঠল,
__”বাড়িতে নেই মানে? কোথায় গেছে?”
__”হাসপাতালে গেছেন… তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।”
ফোনের ওপাশে হঠাৎ নেমে এলো এক অসহনীয় নীরবতা।নাজমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। তার মনে হলো—এই নীরবতা যেন ঠিক ঝড়ের আগের মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, যেখানে বাতাসও নিশব্দে শ্বাস ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন চেপে আসছে। সে জানে—কিছু একটা ভয়ংকর ঘটতে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই ফোনের ওপাশ থেকে ফিরে এলো অরণ্যের কণ্ঠ। এবার সেটি আগুনে পোড়া বরফের মতো—ঠান্ডা, কিন্তু দহনশীল ক্রোধে ভরা।
— “হাসপাতালে গেছে?”
শব্দগুলো আসলো থেমে থেমে, চাপা অথচ ভয়ংকরভাবে পরিষ্কার।
— “আমি নিষেধ করেছিলাম, তবু সে বাইরে গেছে?”
নাজমার কণ্ঠ শুকিয়ে এলো। কিছু বলার আগেই, বজ্রপাতের মতো তীব্র গর্জনে ফেটে পড়ল অরণ্য—
— “আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম, সে বাড়ির বাইরে এক পা-ও যাবে না! গার্ডরা কী করছিল, নাজমা? তুমি কী করছিলে?!”
নাজমার ঠোঁট কাঁপছে। গলার স্বর কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এলো—
— “স্যার… ম্যাডাম খুব কাঁদছিলেন… বললেন, তার বাবার অপারেশন হয়েছে। তিনি শুধু দেখা করে ফিরে আসবেন… তাই…”
— “চুপ করো!”
একটা হুঙ্কারের মতো শব্দ ছুটে এলো ফোনের ওপাশ থেকে। রিসিভারের ভেতর যেন বজ্রনিনাদ বাজলো।
— “আর একটা শব্দও বলবে না! আমার স্পষ্ট আদেশ উপেক্ষা করার এত বড় সাহস কোথা থেকে এলো? আমি এখনই আসছি।
সিমরান ফিরলে… তাকে আমার ঘরে বন্দী করে রাখবে। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ থাকবে।
বুঝেছ, নাজমা?”
নাজমা থমকে গেল। কণ্ঠ স্তব্ধ, চোখ ছলছল করছে। সে বোবা দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নাড়ল—যদিও অরণ্য তা দেখতে পাচ্ছিল না। ফোন কেটে গেল।
নাজমা ধীরে ধীরে ফোনটা নামিয়ে রাখল। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তার হাত কাঁপছে—ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেছে তালু। বুকের ভেতর একটা হাহাকার জমেছে।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সিমরানের মুখ—অশ্রুসিক্ত, আতঙ্কিত, নিষ্পাপ। সেই অসহায় চোখদুটি যেন সাহায্যের আর্তি জানাচ্ছে।
নাজমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু সে জানে—এই করুণা কোনো কাজে আসবে না।
অরণ্য ফিরলেই… এই বাড়িটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে।