Mdigitech

Oronner Chaya Megh Part 9

সতর্কতা: গল্পের এই অংশে সংবেদনশীল বিষয়বস্তু রয়েছে, যার মধ্যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের উল্লেখ আছে। এটি গল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং পাঠকের অনুরোধ অনুযায়ী সংবেদনশীল ভাষায় লেখা হয়েছে।
সিমরানের তীক্ষ্ণ চিৎকারে অরণ্য এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠল সেই পরিচিত নিষ্ঠুর হাসি, যেন সিমরানের প্রতিবাদ তার ভেতরের অন্ধকার উত্তেজনাকে আরও উসকে দিয়েছে। সে ধীরে ধীরে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,
__“এখনো তো কিছুই করিনি কিন্তু তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন? চুক্তিতে যা লিখা ছিল আমি তো তাই করছি।
__”এই চুক্তির চেয়ে আমার মৃত্যু অনেক ভালো ছিল!”
__”তোর জীবন তুই চাইলেই শেষ করে দিতে পারিস। এতে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু তুই মরলে তোর বাবার কী হবে?তুই কি ভেবেছিলি, এই বাড়িতে এসে শুধু রান্না করবি আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবি? আমি কি তোকে রান্নাঘরের পুতুল বানাতে এনেছি?”
সিমরানের চোখে ভয় আর ক্রোধের মিশ্রণ। তার গলা শুকিয়ে গেলেও সে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠল,
__“আপনি আমাকে কেন এনেছেন, সেটা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না যে আমি আপনার এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে রাজি নই?”
অরণ্যের চোখে একটা ঠান্ডা, নিয়ন্ত্রিত তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল, যেন সে সিমরানের প্রতিটি প্রতিরোধকে একটি খেলার মতো উপভোগ করছে। সে বলল,
__“বেশ, আমি তো তোকে জোর করিনি। তুই চাইলেই এখান থেকে চলে যেতে পারিস। কিন্তু যদি এখানে থাকতে চাস, তবে যতই চিৎকার করিস আর যতই প্রতিবাদ করিস, এই বাড়ির দরজা তোর জন্য খোলা হবে না। এখানে থাকতে হলে আমার শর্ত মেনে থাকতে হবে।আমি যা চাই, তাই করতে হবে।”
অরণ্যের কথাগুলো সিমরানের ভয়কে আরও তীব্র করে তুলল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ক্ষীণ কণ্ঠে সে বলল,
__“বাবার জীবনের বিনিময়ে আপনি আমাকে এই জঘন্য খেলায় টেনে এনেছেন। আমাকে কি আপনার মানুষ মনে হয় না? আমারও কিছু ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে, সম্মান আছে। আপনি কেন সেটা বুঝতে চান না? বিপদে পড়েছি বলে কি আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য থাকবে না?”
__“ইচ্ছা-অনিচ্ছা? সিমরান, তুই এখনো বুঝিসনি। এই বাড়িতে তোর ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। তুই এখানে আমার ইচ্ছার অংশ হতে এসেছিস, নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে নয়। তুই যদি আমার কথা মানিস, তাহলে আমি তোর জন্য সব করব। কিন্তু তুই যদি এই প্রতিবাদের খেলা চালিয়ে যাস, তাহলে আমি তোর জীবনকে আরও কঠিন করে তুলব। তুই কি চাস, আমি তোর বাবার চিকিৎসা বন্ধ করে দিই? তুই কি চাস, তোর জীবনে আরও দুর্দশা নেমে আসুক?”
অরণ্যের হাসি আরও গাঢ় হলো। সে ধীরে ধীরে সিমরানের কাছে এগিয়ে এল, তার গরম নিঃশ্বাস সিমরানের গায়ে লাগছিল। সে বলল,
সিমরানের ঠোঁট কেঁপে উঠল, কোনো কথা বের হল না। তার শরীর কাঁপছে, সিমরান জানে, অরণ্যের হুমকি ফাঁকা নয়। তার বাবার জীবন, তাদের ভবিষ্যৎ—সবকিছু এই মানুষটির হাতে বন্দী। কিন্তু তার ভেতরের প্রতিবাদী আত্মা এখনো মরে যায়নি। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
__“আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন, কিন্তু আমি আর ভয় পাই না। আমি জানি, আপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোনো শক্তি বা ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমি এটাও জানি, আপনি আমার শরীর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিন্তু আমার আত্মাকে কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। আমি শুধু আমার বাবার জন্য এখানে থাকব। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন আমি আপনার এই নোংরা খেলায় হাসিমুখে অংশ নেব, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। আমি কখনো আপনার ইচ্ছার ক্রীড়নক হব না।”
অরণ্যের মুখে হাসি ফুটে উঠল সে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
__“তোর এই সাহস আমার ভীষণ ভালো লাগে,সিমরান। তুই যতই প্রতিবাদ করিস, ততই আমার তোকে ভাঙতে ইচ্ছা করে। তুই ভাবছিস, তোর এই কথাগুলো আমাকে থামিয়ে দেবে? কিন্তু তুই জানিস না, তোর প্রতিবাদ আমাকে আরও উৎসাহ দেয়। একটা কথা জেনে রাখ, তুই আমার কাছে শুধুমাত্র একটা খেলনা। আর আমি যখন এই খেলা শুরু করেছি, শেষও করব। তুই যতই চিৎকার করিস, এই বাড়ির দেয়াল তোর কথা শুনবে না। তাই চুপচাপ আমার কথা শোন, নইলে আমি তোর সঙ্গে এমন কিছু করব, যা তুই কল্পনাও করতে পারিছিস না।”
সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল। কিন্তু তার কণ্ঠে একটা মরিয়া শক্তি ফুটে উঠল।
__“আপনি আমার সাথে যা খুশি করতে পারেন, আপনি আমাকে বন্দী করে রাখতে পারেন, আমার শরীরকে আটকে রাখতে পারেন কিন্তু জেনে রাখুন, আমার ভেতরের আমি এখনো মুক্ত। আমি জানি, আমার এই কথাগুলো আপনার মনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমি এটাও জানি, একদিন আপনার এই নিষ্ঠুরতার জন্য আপনাকে মূল্য দিতে হবে।
সিমরানের কথায় অরণ্যের মুখে একটা কঠিন রেখা ফুটে উঠল। সে এগিয়ে এসে এক হাতে সিমরানের গলার নরম হাড় চেপে ধরল। সিমরানের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো, সে ছটফট করতে লাগল। কিন্তু অরণ্যের চোখে কোনো করুণা নেই। ধীরে ধীরে সে হাত নামিয়ে নিল, কিন্তু তার দৃষ্টি সিমরানের ওপর স্থির রইল। সে বলল,
__“তোর সাহস দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। তুই আমাকে মুগ্ধ করিস। কিন্তু তুই কি ভুলে যাস, তুই কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিস? চিন্তা করিস না, আমি তোর এই সাহসকে একটু একটু করে ধ্বংস করব। আমি তোকে আমার মতো করে গড়ে নেব। আর যদি তা না পারি, তোর জীবনকে চিরকালের জন্য অন্ধকারে ডুবিয়ে দেব।”
সিমরানের শরীর থরথর করে কাঁপছে। তার মনের ভেতর একটা যুদ্ধ চলছে—প্রতিবাদের ইচ্ছা আর অসহায়ত্বের বোঝা তাকে দু’ভাগে ভাগ করে দিচ্ছে। সে জানে, অরণ্যের হুমকি অর্থহীন নয়। সে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল, তারপর কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“আমি আমার বাবার জন্য এখানে থাকব। কিন্তু আমি কখনো আপনার এই নিষ্ঠুর খেলার অংশ হব না। আপনি যতই আমাকে ভাঙার চেষ্টা করুন, আমি ভাঙব না।”
অরণ্যের মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল।
__“তোর এই জেদ আমার কাছে নতুন কিছু নয়, সিমরান। কিন্তু আমি যদি তোকে ভাঙতে না পারি, আমার নাম অরণ্য চৌধুরী নয়। তুই দেখবি, তুই নিজেই আমার কাছে নতি স্বীকার করবি।”
সিমরান আর সহ্য করতে পারল না। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এই কান্না যেন তার শেষ অস্ত্র। আর এই অস্ত্র কাজেও লাগল। অরণ্য সিমরানের কান্না দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তার চোখে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠল—করুণা নয়, বরং একটা অধৈর্য। সে একটু হেসে বলল,
__“হয়েছে, হয়েছে, কাঁদতে হবে না। তুই অযথা এত অস্থির হচ্ছিস। আমি এখন তোকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ডাকিনি। আসলে তোর রূপের ঝলক দেখে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, আর কিছু নয়। কাঁদিস না, আমি এখন কিছুই করতে যাচ্ছি না। যে জন্য ডেকেছি, সেটা শোন। আয়, আমার চুলে শ্যাম্পু করে দে। আমার অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি চাই তুই আমাকে তৈরি করে দে। আজ থেকে এটা তোর কাজের একটা অংশ।”
কথাটা শুনে সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার মনের ভেতর একটা ঝড় উঠল। শ্যাম্পু করে দিতে হবে? এটা কি অরণ্যের নতুন অপমানের পদ্ধতি? তার হাত কেঁপে উঠল, তোয়ালেটা শক্ত করে ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল। তার মন প্রশ্নে ভরে গেল—অরণ্য তার সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছে? তার শরীর আর মনের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ—এর উদ্দেশ্য কী? সে প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল। গত কয়েক দিনে সে বারবার প্রশ্ন করতে গিয়ে চুপ করে গেছে। অরণ্যের সামনে তার সব সাহস যেন নিঃশেষ হয়ে যায়।
সে কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,
__“শ্যাম্পু? আমি কেন শ্যাম্পু করে দেব?ভাইয়া আপনি আমাকে কাজের মেয়ের সব কাজ করতে বলুন, বিশ্বাস করুন, আমি একবারও প্রতিবাদ করব না। আপনার সব কাজ করে দেব।”
অরণ্য বাঁকা হাসল।
__“তাহলে আয়, শুরু কর।”
সিমরানের গলায় ক্ষোভ ফুটে উঠল।সে যেন অরণ্যকে অপমান করার জন্যই বলল,
__“নাজমা কি আপনাকে শ্যাম্পু করে দেয়?”
কথাটা শুনে অরণ্য জ্বলে উঠল। তার চোখে তীব্র ক্রোধ ঝিলিক দিল।
__“কী বললি? এতবড় কথা বলতে বুক কাঁপল না? সিমরান,আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি তুই কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি করছিস।
__”ভুল কি বলেছি? নাজমা যদি আপনাকে শ্যাম্পু করে দেয় তাহলে আমিও দিব।
অরণ্য বেশ রেগে বলল,
__”নাজমার মাসিক বেতন নিশ্চয়ই লাখ টাকা নয়।আর বাসায় অনেক কাজের মেয়ে আছে তোর মত কাজের মেয়ে আমার দরকার নেই তবে হ্যা তোর যদি এসব করতে সমস্যা হয়, বল, আমি এখনই হাসপাতালে ফোন করে দিচ্ছি…”
অরণ্য কথা শেষ করার আগেই সিমরান তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। কাঁপা হাতে শ্যাম্পুর বোতল তুলে নিয়ে সে অরণ্যের ভেজা চুলে ছুঁইয়ে দিল। তার আঙুল ধীরে ধীরে চুলে ঘষতে লাগল। প্রতিটি স্পর্শে তার মনের ভেতর একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছিল—অপমান, ঘৃণা, আর অসহায়ত্বের ঝড়। তার চোখে অশ্রু জমা হল, কিন্তু সে তা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল। তার মনে হচ্ছিল, সে শুধু অরণ্যের ঘরে বন্দী নয়, তার আত্মাও এই অন্ধকার জগতে চিরতরে আটকে গেছে।
অরণ্যের কণ্ঠ আবার ভেসে এল,
__“কান্না থামা, সিমরান। তোর এই কান্নাকাটি, প্রতিবাদ এসব আমার উদ্দেশ্য বদলাতে পারবে না তাই কেঁদে কোন লাভ নেই।আর শ্যাম্পুর ব্যাপারটা? এটা তো শুধু শুরু। আমি চাই তুই আমার জীবনের প্রতিটি অংশে জড়িয়ে থাক। আজ থেকে আমার ঘুম থেকে ওঠা, অফিসের জন্য তৈরি হওয়া, আমার খাওয়া-দাওয়া—সবকিছুর দায়িত্ব তোর। আজ থেকে আগামী ছয় মাস দিনের বেলায় তুই এই দায়িত্ব পালন করবি। আর রাতের দায়িত্ব? সেটা তুই ভালো করেই জানিস। চুক্তিতে সব লেখা আছে। তুই যদি ভেবে থাকিস, তোর বাবার অপারেশন হয়ে গেলে তুই মুক্তি পাবি, তাহলে ভুল ভাবছিস। আমি যদি জীবন ফিরিয়ে দিতে পারি, তবে সেই জীবন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও রাখি। কথাটা মাথায় রাখিস।”
অরণ্যের শেষ কথা শুনে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল। তার শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। অরণ্য এতটা হিংস্র হতে পারে, সে যেন কল্পনাও করতে পারেনি। সে কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,
__“দয়া করে এমন কিছু করবেন না। আমি আপনার সব কথা মেনে চলব।”
অরণ্য একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,
__“ঠিক আছে। এবার কাজে মন দে। আর কথা বাড়াস না, আমার সময় নষ্ট হচ্ছে।”
অরণ্য চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার মুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি, যেন সে সিমরানের এই বাধ্যতার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছে।
সিমরান শ্যাম্পু করতে করতে মনে মনে বলল,
*“বাবার জন্য আমি সব করতে পারব। ছয় মাস সব অত্যাচার সহ্য করে নিব। তারপর আমার মুক্তি”*
কিন্তু ওয়াশরুমের ঠান্ডা টাইলস, অরণ্যের নিষ্ঠুর হাসি, আর তার নিজের কাঁপা হাত তাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে লাগল—এই শৃঙ্খল ভাঙা এত সহজ নয়।
🍁
 ঠান্ডায় সিমরানের পা কাঁপছে—ভেজা গায়ে ঠান্ডা যেন হাড়ে গিয়ে বিঁধছে। শাওয়ারের পানির শব্দ থেমে গেছে, কিন্তু তার শরীরের ভেজাভাব এখনো একটুও কমেনি। ভেজা জামাটা তার গায়ে এমনভাবে লেগে আছে, যেন শরীরের সঙ্গে লজ্জা, অপমান আর ক্লান্তি সবকিছুকেই আটকে রেখেছে।
ওপাশে অরণ্য দাঁড়িয়ে—তার ভেজা চুল থেকে এখনও গড়িয়ে পড়ছে ফেনাভরা পানি। চোখে তীব্র অস্থিরতা, ঠোঁটে অদ্ভুত এক রকমের নিয়ন্ত্রণের ছায়া।
সে একবার চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস টেনে নিল, তারপর ধীরে ধীরে বলল,
—“ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে অফিসের জন্য জামা-কাপড় বের করে দে। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ, ভেজা জামা ছেড়ে আমার একটা টি-শার্ট পরে নিস। ঠান্ডা লেগে যাবে নইলে। অফিস থেকে ফিরার সময় তোর জন্য নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আসব।
আসলে… তুই চাইলেও এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারবি না—আমি তোকে বের হতে দিবই না। তাই আমি যা এনে দিব, তুই তাই পরবি। বোঝা গেল?”
সিমরানের বুকের মধ্যে কিছু একটা ভেঙে পড়ল। মনে হল অরণ্যের প্রতিটি শব্দ যেন তার অস্তিত্বকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। অরণ্য শুধু তার শরীরের নয়, তার প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি তার পোশাকের ওপরও দখল নিতে চায়। এই মানুষটা তাকে নিজের সম্পত্তি ভেবে বসে আছে। সে কাঁপা গলায়, নিঃশ্বাস চেপে ধরে বলল,
—“আপনি কেন আমার জীবনের প্রতিটা কোণ নিয়ন্ত্রণ করতে চান? আমি কি আপনার কাছে কোনো প্রাণহীন বস্তু ? আমি কেন বাইরে যেতে পারব না, কেন ঘরের ভিতরে বন্দী থাকতে হবে?কেন আমার নিজের মতো বাঁচার অধিকার থাকবে না? আমার পছন্দ-অপছন্দ, —আপনি ছিনিয়ে নিতে পারেন না।”
তার গলা ভেঙে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখে ছিল শক্তির শেষটুকু। অরণ্য একবার চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ঠোঁটে এক ঠান্ডা, নির্মম হাসি খেলল।
—“তোর এই জেদটা… আমার ভীষন ভালো লাগে সিমরান,” সে গলা নিচু করল, কিন্তু কণ্ঠ ছিল কঠিন, শাসনময়, কিন্তু তুই ভুলে যাচ্ছিস, এই বাড়িতে তোর পছন্দের কোনো দাম নেই। তুই কি পরবি, আর কি পরবি না—সেটা আমি ঠিক করব। আর তুই যতই না বল, যতই মুখ বাঁকাস, শেষ পর্যন্ত তোকে আমার কথাই মানতে হবে।যাইহোক এইসব নিয়ে পরে কথা হবে। এখন আমার অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে। যা, জামা বের কর। আর নিজের ভেজা জামা বদলে আমার টি-শার্ট পরে নিস। ভাবিস না এটা আমার অনুরোধ… এটা আমার আদেশ।”
সিমরান কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল, যেন সে একটা বোবা পুতুল। পা টেনে টেনে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেল সিমরান।  অরণ্যের চোখ তার পেছন ছাড়ল না।  সিমরানের হাঁটার ভঙ্গি, তার থেমে থেমে কাঁপা চলাফেরা, পায়ে ব্যথা—অরণ্যের চোখ এড়ায়নি।
ঘরে ঢুকে সিমরান থমকে দাঁড়াল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে—শরীর কাঁপছে, বুক ধড়ফড় করছে। তবুও সে চোখ মুছে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারির দরজা খুলে সে অরণ্যের জামা-কাপড়ের সারি দেখতে পেল—নিখুঁতভাবে গোছানো স্যুট, শার্ট, টাই। সে একটা কালো স্যুট, একটা সাদা শার্ট আর একটা গাঢ় নীল টাই বের করে বিছানায় রাখল।
তার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, ঠান্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। তবুও অরণ্যের টি-শার্ট পরার কথা ভাবতেই ভিতরে ভিতরে একটা তীব্র ঘৃণার স্রোত বয়ে গেল। সে মনে মনে ফিসফিস করে বলল,
*“আমি এই অপমান আর কতদিন সহ্য করব? কবে এই ছয় মাস শেষ হবে?”
হঠাৎ পিছনে শাওয়ারের শব্দ থেমে গেল। অরণ্য ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। সিমরানকে দেখে সে ভ্রু কুঁচকাল।
—“কি রে, জামা বদলাসনি এখনো?”
সিমরান মাথা নিচু করে শান্ত কণ্ঠে বলল,
—“ঠান্ডা লাগলে আমার লাগবে, আপনাকে ভাবতে হবে না। জামা গুছিয়ে দিয়েছি, এবার কি আমি যেতে পারি?”
তার কণ্ঠে ভয় আর ক্লান্তি মিশে এক অদ্ভুত বিষণ্নতা তৈরি করল। সে জানে, এত সহজে অরণ্য তাকে যেতে দেবে না। তবুও মনে একটা ক্ষীণ আশা—এই মুহূর্তটায় যদি বাঁচা যায়।
অরণ্য কিছু না বলে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো। সিমরান পেছাতে চাইল, কিন্তু ব্যথা-পাওয়া পায়ে হোঁচট খেলো। অরণ্য থামল না, বরং নিচু গলায় কাঁচের মতো ঠান্ডা শব্দে বলল—
—“তুই কি সব কথায় না বলার জন্যেই জন্মেছিস? নাকি এই ভেজা জামা পরে আমাকে নিজের শরীর দেখিয়ে ইচ্ছা করে উত্তেজিত করতে চাইছিস?”
সিমরান চোখ বড় করে তাকাল। লজ্জা, রাগ, অপমান সবকিছু একসাথে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। সে দুই কানে হাত চাপা দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
—“ছি! এসব কথা শোনাও পাপ। আমি তো এখানে থাকতে চাই না! আপনি কি সেটা শুনতে পান নি?”
অরণ্য ঠাণ্ডা গলায় গুনে গুনে বলল,
—“এক… দুই… তিন… এর মধ্যেই নিজের জামা বদলে নিবি। নাকি তুই চাচ্ছিস আমি বদলে দেই? আমার অবশ্য কোন অসুবিধা নেই কাছে আয় আমি নিজেই বদলে দিচ্ছি…”
অরণ্যের কথাটা যেন সিমরানের হাড়ের মধ্যে গিয়ে বিঁধল। ভয়ে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল, চোখে পানি, কণ্ঠে ভয় মিশে গেল—
—“যাচ্ছি! আমি এখনই বদলে আসছি… দয়া করে কাছে আসবেন না…”
বলেই সে দৌড়ে পাশের আলমারির দিকে এগিয়ে গেল— কাঁপতে থাকা হাতে একটি টি-শার্ট তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল,
তার চোখে ঘৃণার ঝলক, তবু তাতে লুকিয়ে আছে এক ধরনের পরাজয়।
ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের ভেজা জামাটা খুলে ফেলল সে, যেন শরীরের সঙ্গে সেঁটে থাকা অপমানটাকেও ছুঁড়ে ফেলছে তারপর অরণ্যের ঢিলেঢালা টি-শার্টটা গায়ে চাপিয়ে নিল পরক্ষনেই একটা মিষ্টি অথচ তীব্র সুবাস এসে নাকে লাগল— গন্ধটা তার কাছে অপরিচত নয়, গত একদিনে অরণ্য এতবার তার কাছে এসেছে যে অরণ্যের গায়ের গন্ধ তার কাছে এখন আর অপরিচত নেই। সেই পরিচিত গন্ধে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল—না ভালোবাসা, না ঘৃণা… কেবল এক অদ্ভুত অপরিচিত ঘনত্বে ভরা অনুভূতি, যেটা থেকে সে চাইলেও আর পালাতে পারবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top