**সতর্কতা**: গল্পের এই অংশে সংবেদনশীল বিষয়বস্তু রয়েছে, যার মধ্যে মানসিক নিয়ন্ত্রণ, ভয়, এবং অসহায়ত্বের বর্ণনা রয়েছে। পাঠকের অনুরোধ অনুযায়ী এটি দীর্ঘ, সংবেদনশীল, এবং গভীর সংলাপের মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে লেখা হয়েছে।
সিমরানের গলা শুকিয়ে গেছে। তার চোখে ভয় আর অসহায়ত্ব মিশে একটা ঝড় তৈরি করছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“ভাইয়া আমি শুধু আমার বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম।আমি কোনো অন্যায় করিনি। আপনি আমাকে এভাবে শাস্তি দিতে পারেন না।”
অরণ্যের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল। সে এক পা এগিয়ে এসে, সিমরানের চোখে চোখ রেখে বলল,
__“ভাইয়া? কে কার ভাইয়া? আর কখনো যেন এই ডাকটা তোর মুখে না শুনি। আর আমি কী পারি আর কী পারি না, সেটা রাতে বুঝবি।এখন চুপচাপ এই ঘরে থাকবি। বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, এই ঘর থেকেও বের হতে পারবি না।”
সিমরানের চোখে অশ্রু ঝরছে, কিন্তু সে আর কিছু বলতে পারল না। তার গলা আটকে গেছে, শরীরে একটা অদ্ভুত অসাড়তা ছড়িয়ে পড়ছে। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়ল। অরণ্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল, তারপর দরজাটা বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল। তালার ধাতব শব্দটা সিমরানের কানে বাজল, যেন তার স্বাধীনতার শেষ দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল।
ঘরের ভেতর শুধু নিস্তব্ধতা আর সিমরানের মনের গভীরে জমে ওঠা ভয় ছাড়া কিছুই নেই। সিমরান হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল।
অরণ্য বাইরে দাঁড়িয়ে নাজমাকে ডাকল। নাজমা তাড়াতাড়ি ছুটে এল। অরণ্য তাকে ঘরের চাবি দিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল,
__“সিমরান যেন এক পাও বাইরে না যায়। ও যদি কিছু বলে, আমাকে জানাবে। কোনকিছুর প্রয়োজন হলে এনে দিবে কিন্তু আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এই দরজা খোলা হবে না। বুঝেছ?”
নাজমা মাথা নাড়ল, তার কণ্ঠে ভয় মিশে আছে। অরণ্য তাকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে বলল,
__“মনে রেখো,আমি আর কোনো অজুহাত শুনব না। যদি সিমরান এই ঘর থেকে বেরোয়…” সে একটু থামল, তারপর বলল, “তুমি জানো কী হবে।”
নাজমা দ্রুত মাথা নাড়ল। অরণ্য ঘুরে হাঁটতে শুরু করল, তার পায়ের শব্দ করিডোরে মিলিয়ে গেল।
ঘরের ভেতর সিমরান হাঁটুতে মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে। তার মনে একটা ঝড় চলছে। অরণ্যের কথাগুলো তার কানে বাজছে—‘রাতে শাস্তি দেব। তুই তৈরি থাকিস।’ কথাটা মনে হতেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠল।
বেশ কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ ঘরের জানালা দিয়ে একটা পাখির ডাক ভেসে এল। সিমরান মুখ তুলে তাকাল। পাখিটা বাইরে, স্বাধীন। পাখিটাকে দেখে সিমরানের মনের গভীরে একটা ছোট্ট আশার আলো জ্বলে উঠল। সে নিজেকে বলল,
__“আমি হারব না। যত কষ্টই হোক, আমি লড়ে যাব। বাবার জন্য, নিজের জন্য।”
সিমরান দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। রাতের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তার হাতে আর কোনো উপায় নেই।
হঠাৎ দরজায় একটা শব্দ হল। সিমরান চমকে উঠল। নাজমা ঘরে ঢুকল—তার হাতে একটা খাবারের ট্রে, চোখে সিমরানের প্রতি সহানুভূতি ঝরছে।
__“ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন?” নাজমার কণ্ঠে উদ্বেগ। সে সিমরানের পাশে এসে বসল।
সিমরানের চোখে আবার জল এল, কিন্তু সে কিছু বলল না। নাজমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। __“ম্যাডাম, আমি এই বাড়িতে অনেক বছর ধরে কাজ করছি। তাই দেখেছি, ছোট স্যার এমনই রগচটা। নিজের যখন যা ইচ্ছা হয়, তাই করে, কারো কথা ভাবে না। তার বাবাও তাকে কখনো বাধা দেন না। আসলে মা ছাড়া বড় হয়েছে তো…”
কথাটা শুনেই সিমরানের কান খাড়া হল।
__“মা ছাড়া বড় হয়েছে মানে?খালামণি, তিনি কোথায়?
নাজমার মুখ ম্লান হয়ে গেল।
__“আপনার খালামণি তো এই বাড়িতে থাকেন না। তিনি অনেক আগেই চলে গেছেন। কেউ জানে না তিনি কোথায়। একমাত্র অরণ্য স্যার জানেন কিন্তু অরণ্য স্যার তাঁকে নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন না।”
সিমরানের মনের ভেতর একটা নতুন আশঙ্কা জাগল। খালামণি যদি এই বাড়িতে না থাকে,তাহলে কোথায় আছে? আর অরণ্যের এই আচরণের পেছনে কী লুকিয়ে আছে? সে কি শুধু তার সিমরানের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে, নাকি এর পেছনে আরও গভীর কোনো কারণ আছে? নাজমা আবার বলতে শুরু করল
__“আপনার খালামণি, শুনেছি, খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু অরণ্য স্যার তার বাবার মতো হয়েছেন—নিষ্ঠুর আর ক্ষমতাপ্রিয়।”
সিমরানের কণ্ঠে একটা দৃঢ়তা ফুটে উঠল। __“নাজমা, আমি খালামণিকে খুঁজে বের করতে চাই। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে?
__সাহায্য?
__” প্লিজ না বলো না। আমাকে জানতে হবে ভাইয়া আসলে কী চায়, কেন আমার সঙ্গে এমন করছে। আমাকে কিছু করতে হবে। আমি এভাবে বন্দি হয়ে থাকতে চাই না। এই অপমান আমি আর সহ্য করব না।”
নাজমা সিমরানের হাত ধরল।
__“কিন্তু আপা, সাবধানে পা ফেলবেন। অরণ্য স্যারের ক্ষমতা অনেক। তার চোখ এড়িয়ে কিছু করা সহজ নয়। তবে…” নাজমা থামল, তার চোখে একটা দ্বিধা।
__“তবে কী, নাজমা?” সিমরান উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
__“অরণ্য স্যারের একটা পুরোনো ডায়েরি আছে,” নাজমা ফিসফিস করে বলল। “আমি জানি সেটা কোথায় রাখা আছে। হয়তো সেখানে কিছু উত্তর পেতে পারেন। কিন্তু যদি অরণ্য স্যার জানতে পারেন, তাহলে…”
সিমরানের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে শুরু করল। তার মনে হল, তাকে কিছু একটা করতে হবে। এই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার জন্য, তার বাবাকে বাঁচানোর জন্য, আর নিজের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য। এইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।
__“আমাকে সেই ডায়েরিটা দেখতে হবে,” সিমরান দৃঢ় গলায় বলল। “আজ রাতেই।”
নাজমা মাথা নাড়ল, কিন্তু তার চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট। “ঠিক আছে, কিন্তু সাবধান। অরণ্য স্যারের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। যাই হোক, আপা, এখন আপনি খাবারটা খেয়ে নিন। স্যার ফোন করে আপনাকে খাবার দিতে বলেছেন।”
__“আমি খাব না, নাজমা। তুমি এসব নিয়ে যাও।”
__“না খেলে অরণ্য স্যার রাগারাগি করবেন।”
__“করুক! সবকিছু উনার মনের মতো হতে পারে না।”
__“কিন্তু স্যার রেগে গেলে…”
__“রেগে গেলে কী হবে? মারবে? মারুক! সেটা আমি বুঝে নেব। তুমি এখন যাও, প্লিজ।”
ধীরে ধীরে রাত নেমে এল। অরণ্যের বিশাল বাড়িটা যেন একটা নিস্তব্ধ দুর্গ, যেখানে প্রতিটি কোণে অন্ধকার জমে আছে। দূরে কোথাও একটা ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে আসছে।আজাদ সাহেব কিছুক্ষণ আগে দেশ ছাড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন তবে অরণ্য এখনও বাসায় ফেরেনি। বাড়িটাকে সিমরানের কাছে বাড়ি কম খাঁচা মনে হচ্ছে বেশি, যেখানে তার প্রতিটি শ্বাস অরণ্যের নিয়ন্ত্রণে বাঁধা।
সিমরান তার ঘরের মেঝেতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। তার চোখ শুকিয়ে গেছে কিন্তু বুকের ভেতরের তীব্র ভয় তাকে গ্রাস করছে। অরণ্যের শেষ কথাগুলো তার কানে এখনো বাজছে—“রাতে শাস্তি দেব। তুই তৈরি থাকিস।” প্রতিটি শব্দ যেন তার হৃৎপিণ্ডে ছুরির মতো বিঁধছে।সে জানে না এই রাত তার জন্য কী নিয়ে আসবে। তার মনের এক কোণে একটা ক্ষীণ আশা জ্বলছে—শেষ পর্যন্ত অরণ্য হয়তো তার ওপর দয়া করবে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা তাকে বলছে, অরণ্যের মনে দয়া মায়ার চিহ্নটুকুও নেই।
হঠাৎ বাড়ির মার্বেলের মেঝেতে ভারী পায়ের শব্দ ভেসে এল। সিমরানের শরীর জমে গেল, হৃৎপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। দরজার কাছে ছায়া পড়ল,অরণ্য ঘরে ঢুকল। তার চোখে মুখে এখনো রাগের তীব্রতা মিশে আছে। সে দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে সিমরানের দিকে এগিয়ে এল।
সিমরান মেঝেতে কুঁকড়ে বসে আছে তার শরীর কাঁপছে। অরণ্য এসে তার সামনে দাঁড়াল,
__”কী ব্যাপার সিমরান? আমি তোকে বলেছিলাম, তৈরি থাকতে। তাহলে এখনও এই অবস্থা কেন? তুই কি ভেবেছিস যে আমার সব কথা অমান্য করে তুই পার পেয়ে যাবি?
সিমরানের বুক কেঁপে উঠল। তার চোখে ভয় আর অশ্রু মিশে একটা ঝড় তৈরি করছে। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__“ক… কেমন তৈরি হওয়ার কথা বলেছিলেন? আমি কি এমন করেছি যে আপনি আমাকে এভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছেন? প্লিজ, একটু বুঝার চেষ্টা করুন।
সিমরানের কথায় অরণ্যের চোখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো, যা তার মুখকে আরও নিষ্ঠুর করে তুলেছে। সে ধীরে ধীরে সিমরানের কাছে এগিয়ে এলো, তার উপস্থিতি যেন ঘরের বাতাসকে ভারী করে দিচ্ছে।
__“তুই কি আমাদের চুক্তির কথা ভুলে গেছিস? তুই এই বাড়িতে কেন এসেছিস? কী শর্ত ছিল আমাদের? আমি যা চাইব, তুই তাই করবি—এমনটাই কথা ছিল, ভুলে গেছিস? আমি চাই, আজ রাতে তুই আমার কাছে আসবি, আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবি, আজ তোর শরীর আর মন দুটোই আমার হবে। আর আমি এখন কোনো ‘না’ শুনতে চাই না বুঝেছিস?
সিমরানের শরীর জমে গেলো, তার হৃৎপিণ্ড যেন বুক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তার শিরায় একটা ঠান্ডা বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__ “অরণ্য ভাই, প্লিজ… আমাকে এভাবে অপমান করবেন না। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমার ভুল হয়েছে, আমি স্বীকার করছি। আর কখনো আপনার অনুমতি না নিয়ে কোথাও যাব না, আমি আপনার কথা মেনে চলব, কিন্তু প্লিজ, আমার সম্মান নষ্ট করবেন না। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।
সিমরানের কণ্ঠ ভেঙে গেল, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অরণ্যের মুখে কোনো ভাবান্তর হল না। সে ধীরে ধীরে সিমরানের কাছে এগিয়ে এল, তার হাত সিমরানের কাঁধে রাখল। তার স্পর্শে সিমরানের শরীর কেঁপে উঠল, যেন একটা ঠান্ডা বিদ্যুৎ তার শিরায় ছড়িয়ে পড়েছে
__“সম্মান?এই দুনিয়া বড়ই নিষ্ঠুর সিমরান। এখানে অনুরোধ, কান্না, মায়া—এসবের কোনো জায়গা নেই। তোর সম্মানের কথা ভাবার সময় তুই পার করে ফেলেছিস। তুই আমার কাছে বিক্রি হয়ে এসেছিস, তাই এখন আমার কথা মানতে হবে।
সিমরান পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল। তার চোখে ভয় আর অসহায়ত্বের মিশে গিয়েছে। অরণ্য তাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসল। অরণ্যের দৃষ্টি এখনো সিমরানের ওপর স্থির, মোমবাতির ক্ষীণ আলো তার শক্তিশালী শরীরে পড়ে একটা অদ্ভুত ছায়া ফেলছে, যেন সে একটা অন্ধকার রাজ্যের নির্মম শাসক, যার চোখে শুধু দখলের আকাঙ্ক্ষা। সে ধীরে ধীরে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলো, প্রতিটি বোতাম খোলার সঙ্গে তার শরীরের রেখাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তার পেশীগুলো যেন একটা যুদ্ধের প্রস্তুতির নিচ্ছে।
সিমরান তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো, তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেলো, বুকের ভেতর ভয় আর অজানা উত্তেজনা মিশে একটা ঝড় তৈরি করছে, যেন তার শরীর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু অরণ্য তাকে সেই সুযোগ দিলো না। তার হাত সিমরানের ওড়না স্পর্শ করলো, ধীরে ধীরে ওড়নাটা খসে পড়লো মেঝেতে। সিমরানের শরীর কেঁপে উঠলো, অরণ্যের আঙুল তার কাঁধে, ঘাড়ে, তার শরীরের প্রতিটি রেখায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলো, যেন সে সিমরানের প্রতিটি কোষে নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করছে, তার স্পর্শ যেন আগুনের মতো পুড়িয়ে দিচ্ছে।
__“আজ থেকে তুই শুধু আমার, সিমরান,” অরণ্য ফিসফিস করে বললো, তার কণ্ঠে একটা গভীর দাবি, যেন সে তার শিকারকে চিরকালের জন্য বেঁধে ফেলছে। কিন্তু কথাটা যেন সিমরানের বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধলো, তার মন চিৎকার করে বলতে চাইলো, “এটা পাপ! এটা অন্যায় কিন্তু তার গলা দিয়ে কথা বের হলো না, তার কণ্ঠ আটকে গেছে ভয়ে। অরণ্যের স্পর্শ, তার দৃষ্টি, তাকে একটা অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছে, তার শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। অরণ্যের হাত ধীরে ধীরে সিমরানের জামার বোতামের দিকে উঠলো। সিমরানের শরীর জমে গেলো, তার হৃৎপিণ্ড যেন বুক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, চোখে একটা গভীর অন্ধকার। সে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে নিলো, তার মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও অরণ্যের স্পর্শ না পেয়ে সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো আর দেখলো অরণ্যের চোখে মুখে একটা রহস্যময় হাসি, যা তার মনকে আরও বিভ্রান্ত করে দিলো। সিমরান অরণ্যের এমন আচরণের মানে বুঝলো না।
অরণ্য এবার সিমরানের দিকে ঝুঁকে বলল,
__“জামা খোলো সোনা।
সিমরান অবাক হয়ে তাকালো, তার মন প্রশ্নে ভরে গেলো, সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
__ “কী… কী বললেন?
অরণ্য ধমকে উঠল,
__ “কী বললাম মানে, কথা কানে যায়নি? আমি বললাম, জামা খোল! সিমরান আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে, আর তুই সেটা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস!”
সিমরান মুখ ঘুরিয়ে নিল, তার চোখে অশ্রু ঝরছে।
__“আমি নিজের ইচ্ছায় এসব করবো, আপনি ভাবলেন কী করে?আমি একটা রক্তে মাংসে তৈরি একটা মানুষ, কোন খেলনা নই। আমারও অনুভূতি আছে সেটা কি আপনি বুঝেন না?
অরণ্যের মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল। __“নিজের ইচ্ছায় করবি না মানে?আমি কেন জোর করে কিছু করবো? তুই তো নিজের ইচ্ছায় নিজেকে আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিস, আমার শারীরিক চাহিদা মিটানোর শর্তে রাজি হয়ে আমার কাছে এসেছিস। তার মানে আমাকে সন্তুষ্ট করা তোর দায়িত্ব, তাহলে আমি জোর করে কেন আদায় করবো? জোর করে কিছু করার হলে সেদিন যখন তুলে এনেছিলাম, তখনই সব করতে পারতাম। তাহলে এত টাকা, সময়, ধৈর্য খরচ করলাম কেন? আমি তোকে সময় দিয়েছি, সিমরান,এখন তোর পালা।”
__“আপনি ভালো করেই জানেন আমি নিজের ইচ্ছায় রাজি হইনি আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন। আপনি একটা অমানুষ।
কথাটা শুনে অরণ্যের চোখে রাগ জ্বলে উঠলো সে হঠাৎ সিমরানের চুলের মুঠি ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
__“তোর ন্যাকামি অনেক সহ্য করেছি, আর না! যদি রাজি না থাকিস, দরজা খোলা আছে, বেরিয়ে যা! একদম ঢং করবি না। আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে, সিমরান। যদি সাহস থাকে,বেরিয়ে যা!”
ব্যথায় সিমরান কুঁকড়ে গেলো, তার মুখ থেকে একটা হালকা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো, যেন তার যন্ত্রণা তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অরণ্য তার চুল ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর বিছানার পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলো। সিমরানের বুঝতে দেরি হলো না—অরণ্য হাসপাতালে ফোন করবে, তার বাবার চিকিৎসা বন্ধ করে দিবে তাই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, __“হাসপাতালে ফোন করবেন না, প্লিজ! আমি… আমি জামা খোলছি। আমি সব করতে রাজি, দয়া করে আমার বাবাকে বাঁচান, আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো, কিন্তু বাবাকে কষ্ট দেবেন না প্লিজ।”
অরণ্য মুখে কিছু বললো না, ফোন হাতে রেখেই সে ইশারায় সিমরানকে জামা খোলার নির্দেশ দিলো। সিমরানের হাত কাঁপতে কাঁপতে জামার বোতামে উঠলো, তার আঙুলগুলো স্থির হচ্ছে না, ক্রমশ কাঁপনি বাড়ছে, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে জামার প্রথম বোতামটা খুললো, কিন্তু এবার সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না—ডুকরে কেঁদে উঠলো, তার কান্না ঘরের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো, যেন তার হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণা বেরিয়ে আসছে। তবে অরণ্যের মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না, তার চোখে সেই শান্ত, নিষ্ঠুর দৃষ্টি, যেন সে সিমরানের কান্নার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো, তার হৃদয়ে কোনো অনুকম্পা নেই। সে ফোনটা ধীরে ধীরে বিছানার পাশে রাখলো, তারপর সিমরানের পাশে বসে কিছুটা নরম কণ্ঠে বললো,
__“হয়েছে, কাঁদিস না। উঠ। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। আমি তোকে সময় দিচ্ছি সিমরান, তবে নিজের শরীর আর মন দুটোকেই তৈরি করে নে। আজ হোক বা কাল, আমার সঙ্গে তোকে ঘনিষ্ঠ হতেই হবে। আমি যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নিই, কেউ আমাকে বাধা দিতে পারে না, তবে এই ব্যাপারে আমি তোর সাথে জোর করতে চাই না। আমি চাই তুই নিজ থেকে সব কর, তাই সময় দিচ্ছি তারমানে এই নয় যে আমি একবারে ছাড় দিয়ে দিব। সময় নিয়ে নিজেকে তৈরি কর, এটাই কিন্তু শেষবার।”
সিমরান অরণ্যের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো, তার চোখে প্রশ্ন আর ভয় মিশে গেছে। অরণ্য আবার বললো,
__”ভয় পাস না কথা দিচ্ছি, তুই যদি আমার অবাধ্য না হোস, আমিও তোর প্রতি নিষ্ঠুর হব না। কিন্তু তুই যদি আমার কথার বাইরে কিছু করিস, এই সুযোগ দ্বিতীয়বার পাবি না। তুই যদি আমার কথা অমান্য করিস, তাহলে আমার নিষ্ঠুরতা তোর জীবনকে ধ্বংস করে দেবে।”
সিমরান অবাক চোখে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মন প্রশ্নে ভরে গেল। অরণ্যের এই আচরণ— হঠাৎ এই নরম ভাব, এই ক্ষমা—এর পিছনে কী লুকিয়ে আছে? সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তার গলা আটকে গেল।
অরণ্য আবার বলল,
__“বললাম তো, এখন কিছু করতে হবে না। উঠ। নিচে গিয়ে রাতের খাবার তৈরি কর।”
সিমরান এখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে অরণ্যের কণ্ঠে একটা সতর্কতার সুর ফিরে এলো।
__“যদি এভাবেই শুয়ে থাকিস, তবে আমি কতক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবো, সেটা কিন্তু বলতে পারছি না। পরে আমাকে দোষ দিস না, তুই নিজেই তোর ভাগ্য লিখছিস।”
কথাটা শুনে সিমরানের হৃদয়ে ভয়ের ঢেউ খেলে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো, তার শরীর কাঁপছে, চোখে অশ্রু, কিন্তু বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত স্বস্তি যেন একটা ক্ষীণ আলো জ্বালিয়েছে। সে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো, তার পা টলছে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো। অরণ্যের দিকে একবার তাকিয়ে, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু দুই পা এগোতেই অরণ্য বলে উঠলো,
__“দাঁড়া!”
সিমরানের নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেলো, তার হৃদয় আবার কেঁপে উঠলো। সে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে তাকালো,
__“আমি এখনই খাবার বানিয়ে দিচ্ছি, প্লিজ, কিছু করবেন না। আমি আপনার কথা মেনে চলবো।
অরণ্য কিছু না বলে মেঝেতে পড়ে থাকা সিমরানের ওড়নাটা তুলে নিলো, তারপর ধীরে ধীরে সিমরানের কাছে এগিয়ে এলো, তার মাথায় ওড়নাটা টেনে দিয়ে আলতো হাতে সিমরানের জামার খোলা বোতামটা লাগিয়ে দিয়ে বললো,
__“এবার যা আর চোখ মুছ, আমি তোকে এভাবে কাঁদতে দেখতে চাই না।”
সিমরান অরণ্যের এই দ্বৈত আচরণের মানে বুঝতে পারলো না—একদিকে নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে এই অদ্ভুত কোমলতা। এর পিছনে কী লুকিয়ে আছে? মনে প্রশ্ন জাগলো কিন্তু প্রশ্ন করলো না—তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, তার পায়ের শব্দ করিডোরে মিলিয়ে গেলো, যেন সে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
রান্নাঘরে পৌঁছে সিমরান দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, তার শরীর কাঁপছে সে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
__“মাত্র ছয় মাস, তারপর আমার মুক্তি। এ কদিন আমাকে সব সহ্য করতে হবে তারপর আমি আমার নিজের জন্য বাঁচবো, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হবো।