Mdigitech

Oronner Chaya Megh Part 5

সিমরান বাসায় ফিরে আসল। অরণ্য তার কথা রেখেছে। সন্ধ্যার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফোন এল—সিমরানের বাবার অপারেশনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সেরা হাসপাতাল, সেরা ডাক্তার—সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু সিমরানের মন শান্ত হল না। তার বাবার জীবন বাঁচলেও, সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। চুক্তিপত্রে সই করার মুহূর্তটা তার মনে বারবার ফিরে আসছিল।মনে হচ্ছিলো যদি খালামণি তাকে সাহায্য না করে তখন কী হবে?
সন্ধ্যার ম্লান আলো ঘরে ঢুকছে। সিমরান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে এসব নিয়ে ভাবছিলো হঠাৎ বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দে তার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, একটা কালো, ঝকঝকে গাড়ি তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার নেমে এসে দরজায় কড়া নাড়ল। সিমরানের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে শুরু করল। দরজা খুলতেই ড্রাইভার শান্ত কণ্ঠে বলল,
__“ম্যাডাম, অরণ্য স্যার আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন।”
সিমরানের মন চিৎকার করে উঠল,
__“না, আমি যাব না!” কিন্তু চুক্তিপত্রের কথা তার মনে পড়ল। কাগজে স্পষ্ট লেখা ছিল—আগামী ছয় মাস অরণ্যের ব্যক্তিগত সঙ্গী হিসেবে তাকে অরণ্যের বাড়িতে থাকতে হবে। তার বাবার জীবনের বিনিময়ে সে এই শর্তে সই করেছে। এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। সিমরান একটা ছোট ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। প্রতিটি পদক্ষেপে তার শরীর ভারী হয়ে আসছিল, যেন সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক অজানা অন্ধকার পথে হাঁটছে।
বাড়ির দরজা বন্ধ করার সময় তার চোখ টলটল করে উঠল। সিমরান জানে এই বাড়ি, যেখানে তার বাবার স্মৃতি, তার শৈশবের হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে, সেটা ছেড়ে সে আজ যে অবস্থায় বেরিয়ে যাচ্ছে, একই অবস্থায় কি আর ফিরতে পারবে? এরপর হয়তো সবকিছু বদলে যাবে—পরিবেশ, পরিস্থিতি, এমনকি সিমরান নিজেও। তবুও নিজেকে শক্ত করে, ড্রাইভারের পেছন পেছন গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। দরজার ভেতরে তাকাতেই সিমরানের শ্বাস আটকে গেল। কারণ গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে অরণ্য। তার গায়ে সাদা শার্ট, চকচকে কালো স্যুট, আর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাতের অন্ধকারে আরও ভয়ংকর মনে হল। সিমরান ভেবেছিল অরণ্য শুধু গাড়ি পাঠিয়েছে; সে নিজে আসবে, এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। তার পা থমকে গেল, চোখে অবিশ্বাস আর ভয় মিশে গেল।
__“কী হল, মিস সিমরান? থেমে গেলে কেন? উঠে এসো,” অরণ্য বলল, তার কণ্ঠে একটা শান্ত, কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ সুর বেজে উঠল। তার ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি, যেন সে সিমরানের প্রতিটি আবেগ উপভোগ করছে।
সিমরানের গলা শুকিয়ে গেল।
__“আপনি… আপনি এখানে?আমি ভেবেছিলাম শুধু গাড়ি…”
অরণ্য হাসল।
__“বলেছি না, আজ থেকে তুমি আমার আর তোমার সমস্ত দায়িত্বও আমার। তাহলে তোমাকে একা ছাড়ব কীভাবে?কেন শুধু গাড়ি পাঠাব? আমি নিজে এসেছি, তোমাকে আমার জগতে স্বাগত জানানোর জন্য।”
সিমরান কোনো উত্তর দিতে পারল না। অরণ্য আবার একটু হেসে বলল,
__“চুক্তি তো তুমি মেনেই নিয়েছ। এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। চলে এসো।”
কাঁপা পায়ে সিমরান গাড়িতে উঠল। গাড়ির ইঞ্জিনের নিচু গর্জন রাতের নিস্তব্ধতায় মিশে গেল। সিমরান অরণ্যের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে সিটের এক কোণে গুটিয়ে বসল কারণ অরণ্যের উপস্থিতি তার পাশে একটা অদৃশ্য শিকলের মতো মনে হচ্ছে । অরণ্য হঠাৎ ঘুরে তাকাল, তার চোখে একটা অধৈর্য ভাব ফুটে উঠল। সে কঠিন কণ্ঠে বলল, __“এত দূরে বসেছো কেন?ওখানে নয়, আমার কাছে এসে বসো।”
সিমরানের বুক কেঁপে উঠল। সে মাথা তুলে অরণ্যের দিকে তাকাল, তার চোখে ভয় আর প্রতিরোধের একটা ক্ষীণ চিহ্ন ফুটে উঠল। __“আমি এখানেই ঠিক আছি,”
অরণ্যের ভ্রূ কুঁচকে গেল। মুখ কঠিন হয়ে গেল।
__“তুমি ঠিক আছো কিনা আমি তো জানতে চাইনি তাছাড়া তুমি ঠিক থাকলেও আমি ঠিক নেই, আমি যখন কিছু বলব, তুমি চুপচাপ তা পালন করবে। এটাই তোমার দায়িত্ব। আমার সঙ্গে কখনো দ্বিমত পোষণ করবে না। তোমাকে আমার পাশে বসতে বলেছি মানে  তুমি চুপচাপ আমার পাশে এসে বসবে।”
সিমরান অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল,
__“আমি তো কাছেই বসেছি।”
অরণ্যের মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল। সে সিমরানের দিকে ঝুঁকে বলল,
__“পাশে বসতে বলেছিলাম, তোমার ভালো লাগেনি? ওকে, ফাইন। এখন আমার কোলে এসে বসো।”
সিমরান মৃদু চিৎকার করে বলল,
__“আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? কী বলছেন এসব?”
__“বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়, সিমরান। যা বললাম, তাই করো,” অরণ্যের কণ্ঠে একটা হিমশীতল কঠোরতা ফুটে উঠল।
__“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, গাড়িতে ড্রাইভার আছে!” সিমরান ফিসফিসিয়ে বলল, তার গলা কাঁপছিল।
অরণ্যের কঠিন কন্ঠে বলে উঠল,
__“তুমি যদি এভাবে আমার সঙ্গে তর্ক করো, তাহলে আমি এখনই হাসপাতালে ফোন করব।” সে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াল।
সিমরানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার চোখে ভয় আর অসহায়ত্ব ঝলসে উঠল।
 __“না, ফোন করবেন না, প্লিজ! আমি… আমি বসছি।”
কথা বলেই সিমরান অরণ্যের পাশে সরে এল। তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল, প্রতিটি নিশ্বাস যেন যুদ্ধ করছিল। অরণ্য ফোনটা পকেটে রেখে হঠাৎ হ্যাচকা টানে সিমরানকে নিজের কোলে তুলে নিল। সিমরান হকচকিয়ে উঠল, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারল না। সে ড্রাইভারের দিকে তাকাল, যদিও ড্রাইভার সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু তার উপস্থিতি সিমরানকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। সে ফিসফিসিয়ে বলল,
__“ড্রাইভারের সামনে… আপনি এসব কী করছেন?”
অরণ্যের ভ্রূ কুঁচকে গেল। সে হঠাৎ চিৎকার করে বলল,
__“ড্রাইভার, গাড়ি থামাও!”
গাড়ি থেমে গেল। গাড়ি রাস্তার পাশে থামতেই অরণ্য ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“বাইরে যাও আমি না ডাকা পর্যন্ত আসবে না।
ড্রাইভার কোনো কথা না বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেল, দরজা বন্ধ করে দূরে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতরে এখন শুধু অরণ্য আর সিমরান। তাতে সিমরানের অস্বস্তি আর ভয় দুটোই যেন বেড়ে গেল।অরণ্য সিমরানের দিকে ঝুঁকে, তার চোখে তীব্র দৃষ্টি রেখে বলল,
__“এবার আর কোনো অজুহাত নেই। Now kiss me.”
অরন্যের কথায় সিমরানের শরীর যেন জমে বরফ হয়ে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
__“কী বলছেন এসব?”
অরণ্যের চোখে একটা ভয়ংকর শীতলতা ফুটে উঠল। সে ধীর কণ্ঠে বলল,
__“আমাকে রাগিও না, সিমরান। তুমি জানো আমি কী করতে পারি। এখন আমার কথা না মানলে তোমার বাবার চিকিৎসার কথা ভুলে যাও।”
সিমরানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। তার মনের ভেতর একটা তীব্র যুদ্ধ চলছিল—বাবার জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব আর নিজের সম্মানের মধ্যে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অরণ্যের হুমকির সামনে তার আর কোনো উপায় খোঁজে পেল না কাঁপা হাতে সে অরণ্যের কাছে ঝুঁকল, চোখ বন্ধ করে দিল। তার শরীর কাঁপছিল, মনের ভেতর ঘৃণা আর অসহায়ত্বের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অরণ্য তার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলে উঠল,
__“এই তো, এবার ঠিক আছে। একটা কথা মনে রেখো আমার মনোরঞ্জন করা,আমার চাহিদা মেটানোঅ তোমার দায়িত্ব। তুমি আমার কথা মেনে নিলে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে।আর না মানলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে”
গাড়ির ভেতরের নিস্তব্ধতা যেন সিমরানের হৃৎপিণ্ডের দ্রুত ধুকপুকের শব্দকে আরও তীব্র করে তুলল। অরণ্যে সিমরানের এতটাই কাছে ছিল যে তাদের নিঃশ্বাস একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। সিমরানের শরীর বরফের মতো জমে যাচ্ছে। তার চোখ বন্ধ, হাত কাঁপছে, আর মনের ভেতর একটা অসহায় চিৎকার তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। অরণ্যের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার গালে লাগছে, ধীরে ধীরে অরন্যের ঠোঁট সিমরানের ঠোঁটের এতটাই কাছে নেমে এলো যে মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে ঠোঁটে ঠোঁট মিশে যাবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে অরণ্য থেমে গেল।
তার ঠোঁটে সেই পরিচিত বাঁকা হাসি ফুটে উঠল সিমরানকে তার কোল থেকে নামিয়ে পাশের সিটে বসিয়ে দিল তবে তার হাত এখনও সিমরানের কাঁধে হালকাভাবে স্পর্শ করে আছে, যেন সে তার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায় না।
অরণ্য সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
__“এরপর থেকে আমার সঙ্গে আর তর্ক করবে না, আশা করছি।”
কথাগুলো সিমরানের কানে বাজের মতো বাজল। তার মনে হল, যেন একটা অদৃশ্য শিকল তার চারপাশে আরও শক্ত হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও অরণ্য তাকে চুমু খায়নি ভেবে হাফ ছেড়ে বাঁচল।
__”এখন ছেড়ে দিয়েছি বলে ভেবো না সবসময় ছাড় পাবে। নিজের মন আর শরীর দুটোকেই তৈরি করে নাও আজ থেকে তোমার নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে।”
অরণ্যের কথায় কোনো আবেগ ছিল না, শুধু একটা ঠান্ডা নির্দেশ, যা তার ক্ষমতার দম্ভকে আরও স্পষ্ট করে তুলল। সিমরানের চোখের জল লুকানোর জন্য মাথা নিচু করে নিল। সিমরান আন্দাজ করতে পারল, এই মুহুর্ত থেকে তার জীবনে কী এক দুর্বিষহ অধ্যায়ের শুরু হতে চলেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top